ঢাকার বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালে নবজাতক ও প্রসূতির মৃত্যুতে দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে চিকিৎসকদের করা ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। ওই দুই চিকিৎসকের জামিন হওয়ার এই সিদ্ধান্ত নেয় আন্দোলনরত চিকিৎসকেরা।
তবে এই ঘটনায় আবার স্পষ্ট হলো, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া খুব কঠিন। বাংলাদেশে চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুলের কারণে প্রতিকার পাওয়ার আলাদা কোনো আইন নেই। ক্ষতিপূরণ বা ফৌজদারি মামলা করলে তা থেকে প্রতিকার পাওয়া কঠিন। কারণ, চিকিৎসকরা এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান নেন। রোগীদের জিম্মি করে ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি দেন। আর বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলেও (বিএমডিসি) অভিযোগ করে তেমন প্রতিকার পাওয়া যায় না।
চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তারা গ্রেপ্তার হলে চিকিৎসকরা মাঠে নেমে যান। তারা চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে, রোগীদের জিম্মি করে- যা চান তা আদায় করে নেন। এর ফলে পরিস্থিতি এখন চিকিৎসক আর রোগীরা যেন পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন। অথচ সম্পর্কটি সেবা দেওয়া আর নেওয়ার।
যা ঘটেছে সেন্ট্রাল হাসপাতালে
সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার (গাইনি) অধীনে গত ৯ জুন ভর্তি হন মাহাবুবা রহমান আঁখি। কিন্তু সেদিন ডা. সংযুক্তা হাসপাতালেই ছিলেন না। পরে তার দুই সহযোগী ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহা আঁখির ডেলিভারি করানোর চেষ্টা করেন। এতে আঁখির সন্তানের জটিলতা দেখা দেওয়ায় তাকে এনআইসিইউতে রাখা হয়। একই সঙ্গে আঁখির অবস্থার অবনতি হলে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
গত ১০ জুন বিকেলে আঁখির সন্তানের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী ধানমন্ডি থানায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা, ডা. মুনা সাহা, ডা. মিলি, সহকারী জমির, এহসান ও হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকেও আসামি করা হয়। ১৫ জুন রাতে ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা সাহাকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর গত ১৮ জুন দুপুরে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাহবুবা রহমান আঁখিও মারা যান।
গ্রেপ্তারের পর গত ১৫ জুন ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা দায় স্বীকার করে আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গত ১৬ জুন আদালত সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অপারেশন বন্ধের নির্দেশ দেন।
গত তিন মাস ধরে সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। এ সময় তার শারীরিক অবস্থা “স্বাভাবিক” ছিল বলেও চিকিৎসক জানিয়েছিলেন। নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই সন্তান প্রসব সম্ভব বলে আশ্বস্তও করেছিলেন ডা. সংযুক্তা সাহা।
৯ জুন দিবাগত রাত একটার দিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তার অধীনে মাহবুবাকে ভর্তি করা হলেও ওই সময় ডা. সংযুক্তা সাহা দেশেই ছিলেন না। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের জানায়, সংযুক্তা সাহা আছেন এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) কাজ করছেন।
এই পরিস্থিতিতে গত ১৭ জুলাই থেকে দুই দিন বেসরকারি হাসপাতালে রোগী দেখা বন্ধ এবং চেম্বার ও হাসপাতালে রোগী দেখা ও অস্ত্রোপাচার বন্ধের কর্মসূচি পালন শুরু করেন গাইনি চিকিৎসকরা। এর আগে ১৬ জুলাই তারা সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। তবে ১৮ জুলাই দুপুরের পর দুই চিকিৎসকের জামিন হওয়ায় তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।
চিকিৎসকদের এমন ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট শুনানির অপেক্ষায় আছে। ২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে রিটটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
তিনি বলেন, “আদালত রুলও দিয়েছেন। কর্তব্য পালনকালে চিকিৎসক ও নার্সদের ধর্মঘট কেন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হবে না-এই মর্মে রুল দেওয়া হয়।”
তিনি বলেন, “রোগী মারা গেলেই যেমন সেটা চিকিৎসকের অবহেলা নয়, আবার চিকিৎসকের অবহেলায়ও রোগী মারা যান। ফলে চিকিৎসায় অবহেলা আবার চিকিৎসকের ওপর হামলা দুইটিরই প্রতিকার প্রয়োজন। ফৌজদারি আইনে তো মামলা করা যায়। কিন্তু রোগীদের জিম্মি করে এর বিরুদ্ধে ধর্মঘট করলে তো আর সেটা এগোয় না। বিএমডিসি যদি দায়িত্ব পালন করতো, তাহলেও হতো। তারা যদি লাইসেন্স বাতিল করতো, তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসতো।”
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) স্ট্যান্ডিং রিকগনিশন কমিটির চেয়ারম্যান ও স্বাচিপের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, “আমরা তো রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতেই চাই। তবে চিকিৎসার পরিবেশ ভালো করতে পারলে রোগীদের সঙ্গে দূরত্ব কমবে। কে কোথায় চিকিৎসা নেবেন তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। এখন আউটডোরে একজন চিকিৎসককে ৫০ জন রোগী দেখতে হয়। তখন তিনি হয়তো রোগীদের প্রতি ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেন না। আবার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে যদি পকেট থেকে টাকা দিতে হয়, তাহলে এটাও রোগীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকরা একটা অংশ। পুরো ব্যবস্থাপনা তাদের হাতে নেই৷ কিন্তু দায় তাদের ওপরই পড়ে।”
তার কথা, “কোনো চিকিৎসক যদি ফৌজদারি অপরাধ করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করায় তো কোনো বাধা নেই। প্রতিকার পেতে যে কেউ মামলা করতে পারেন। আবার বিএমডিসিতেও অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণ হলে আমরা চিকিৎসকের লাইসেন্স বাতিলসহ আরও অনেক ব্যবস্থা নিই। আর সরকার নতুন একাটি আইন তৈরির শেষ পর্যায়ে আছে। সেটা হলে আমরা মনে হয় সেই আইনেও প্রতিকার পাওয়া যাবে।”
তিনি মনে করেন, “সবার উপরে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা উন্নত করা অনেক জরুরি। সেটা হলে অনেক জটিলতা কমে যাবে। সরকার কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। যেমন: ফি বেঁধে দেওয়া, হাসপাতালগুলোর মান অনুযায়ী এ, বি, সি এরকম বিভিন্ন ক্যাটাগরি করে দেওয়ার কাজ চলছে। এগুলো হলে রোগীরা বুঝতে পারবেন যে তিনি কোথায় চিকিৎসা নেবেন।”
সুত্র- ডয়চে ভেলে/ ঢাকা ট্রিবিউন