শীতকালে শীতের হাত থেকে বাঁচতে যে সব পাখি ওদের নিজ দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। তাদেরকে বলা হয় অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি। প্রতিবছর শীতকালে আমাদের দেশেও কিন্তু এরকম কিছু অতিথি পাখি আসে। ওরা আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে।শীতের সময় আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা চলে আসে দলবেঁধে। হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা এসব অতিথি হাঁস কিংবা সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা সরালির ঝাঁকের দিকে যদি কখনও তাকান, দেখতে পাবেন ইংরেজি ভি অক্ষরের আকৃতিতে এগিয়ে চলছে পাখির দল।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি দেখা যায়।
প্রতিবছর শীতকালে আমাদের দেশেও কিন্তু এরকম কিছু অতিথি পাখি আসে। ওরা আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে।আমাদের দেশে মোট পাখি আছে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির। এর মধ্যে ২৪৪ প্রজাতির পাখিই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে না। এরা আমাদের দেশের পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে এরা আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। তারপর মার্চ থেকে এপ্রিলের দিকে ওদের দেশে বরফ গলতে শুরু করলে ফিরে যেতে থাকে নিজেদের দেশে।
কয়েকটা অতিথি পাখির নাম বালি হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, পাতারি হাঁস, বৈকাল হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ধূসর রাজহাঁস, ভূতি হাঁস, চিতি হাঁস, বারো ভূতি হাঁস, বৌমুনিয়া হাঁস। এতো গেলো কেবল কতোগুলো অতিথি হাঁসের নাম।
আবার কতোগুলো অতিথি কবুতরও আছে। ওদের নামগুলোও এরকমই মিষ্টি জাল কবুতর, তারপর গঙ্গা কইতর। আরো আছে পান্তামুখী, লালশির, নীলশির, রাঙ্গামুরি, পাথরঘুরানি বাতান, আরো কতো মিষ্টি মিষ্টি সব নাম! কিছু কিছু পাখির অবশ্য পুরোটুকু নাম দেয়নি, বিদেশি নামগুলো দেশি বানিয়ে নিয়েছে। যেমন, কমন কূটের নাম দিয়েছে কালো কূট, স্পটেড ক্রেকের নাম দিয়েছে চিত্রা ক্রেক, আবার ওয়াটার রেইলের নাম দিয়েছে তারা জলছড়ি রেইল। কী অদ্ভূত মিষ্টি না নামগুলো!
কয়েকটি অতিথি পাখির বণনা দেওয়া হলো-
ইউরেশিয়ান কার্লিউ বা বড়ো গুলিন্দা পাখিঃ
ইউরাশিয়ান কার্লিউ বা বড়ো গুলিন্দা পাখি ইউরোপ ও এশিয়ার উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। এই পাখিগুলো বৃটেন আর আয়ারল্যান্ডে বেশি দেখা যায়। আফ্রিকা আর ইউরোপ এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এরা ঘুরতে বের হয়। এই পাখিগুলো সাধারণত কাদার ভেতর ঘুরে বেড়ায় এবং পোকা মাকড় খায়।
রেড-ক্রেস্টেড পোচার্ড বা রাঙ্গামুরি পাখিঃ
রেড-ক্রেস্টেড পোচার্ড বা রাঙ্গামুরি পাখি হাঁসের একটি প্রজাতি। এরা ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় বসবাস করে। শীতকালে এরা বাংলাদেশের নয়তো পশ্চিম আফ্রিকার কোনো দেশে চলে যায়। কখনো কখনো আবার আফ্রিকায়ও যায়। এরা সবসময় দলবেঁধেই ঘোরাঘুরি করে। পানির বিভিন্ন উদ্ভিদ এই পাখিগুলোর প্রধান খাবার।পানিতে ডাইভ দিয়ে ভাসমান উদ্ভিদ বা পোকা ধরে ধরে খায় এজন্য এই হাঁসকে ডাইভিং হাঁস বলা হয়।
হোয়াইট স্টর্ক বা সাদা মানিকজোড় পাখিঃ
সাদা মানিকজোড় পাখিটি অনেক বড় আকারের পাখি। এই পাখির লেজগুলো অনেক লম্বা এবং লাল রঙের হয়। এই পাখির প্রধান খাবার হচ্ছে পোকা মাকড়, সাপ, ব্যাঙ,এবং আরো অনেক ছোটো ছোটো প্রাণী। সাদা মানিকজোড় পাখি তেমন কোনো শব্দই করতে পারে না, কেবল হিসসস করে একটা মৃদু শব্দ তৈরি করতে পারে। মিশরে এই পাখিগুলোকে মনে করা হতো আত্মার প্রতীক। গ্রিসে এই পাখিকে এতোই শ্রদ্ধা করা হতো যে, কেউ মানিকজোড়কে মারলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত।
সোশিয়েবল ল্যাপউইং বা হট্টি-টি পাখিঃ
হট্টি-টি পাখি তার টি-টি-টি ডাকের জন্য খুবই বিখ্যাত। এটিকে আমাদের দেশে তিতির পাখি নামে ডাকা হয়। ছোট্ট এই পাখিটা সাধারণত মাটিতেই বাস করে, মাটি থেকে পোকা মাকড় ধরে খেয়ে থাকে। রাশিয়া আর কাজাখাস্তানে এই পাখি গুলোর বসবাস। শীতের সময় গরম জায়গার খোঁজে বেরিয়ে পরে। বাংলাদেশে, আসেই, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, আর্মেনিয়া, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, সিরিয়া, সুদান, তুরস্ক, ইসরায়েল, ওমান, ইরিত্রিয়ায় এই পাখিগুলো শীতের মৌসুমগুলো কাটিয়ে থাকে।
রুডি শেলডাক বা বালি হাঁসঃ
বালি হাঁসেরা ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম চীনে বাস করে। শীতের শুরুতেই এই পাখিগুলো আমাদের দেশে ঘুরতে আসে। দিনদিন ইউরোপে বালি হাঁসের সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। গিরিয়া হাঁস যেমন দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে,বালি হাঁস কিন্তু ঠিক তার উল্টো। বালি হাঁস একা একা থাকা পছন্দ করে, অথবা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। পরিভ্রমনে বের হওয়া ছাড়া বালি হাঁস সাধারণত বড়ো কোনো দল বাঁধে না। তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ায় এই পাখিকে অনেক পবিত্র পাখি বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধদের কাছেও এই পাখির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
গার্গেনি বা গিরিয়া হাঁসঃ
গার্গেনি বা গিরিয়া হাঁসের মূল নিবাস হলো ইউরোপ এবং এশিয়ার পশ্চিমের দেশগুলোতে।এরা বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে চায় না। এই পাখিগুলো ভ্রমণ করতে অনেক বেশি পছন্দ করে। মাঝে মাঝে এই পাখিগুলো উড়তে উড়তে অস্ট্রেলিয়াতে চলে যায়। এই পাখি গুলো একসাথে দলগতভাবে উড়তে পছন্দ করে।পুরুষ পাখি গুলো অনেক চঞ্চল প্রকৃতির হয় পক্ষান্তরে মহিলা পাখি গুলো অনেক শান্ত স্বভাবের হয়।