রুটিন মাফিক ক্লাস আর বইয়ের পৃষ্ঠায় আইনের শত শত ধারাকে ছুটি জানিয়ে ধূলাময় শহরের যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে, সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে আমরা ৪৩ জন ছুটে যাই, লবণাক্ত জলরাশির স্পর্শ পেতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে।
রাত ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। পরদিন সকাল ৭টায় ডলফিন মোড়ে পৌঁছায় আমাদের বাস। পূর্বে নির্ধারণ করা হোটেল গ্র্যান্ড বিচ রিসোর্টে চেক ইন করি আমরা।
হোটেলের ৬তলায় ৬০২ নম্বর কামরাতে আমার জায়গা হয়। সকাল ৯টায় গোসল করে চান্দের গাড়িতে মেরিন ড্রাইভে যাবার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নিচে নামি। রওনা হবার আগে সকালের নাস্তা সেরে নিই। এরপর চান্দের গাড়িতে চেপে রওনা দেই মেরিন ড্রাইভে। একপাশে বিশাল সমুদ্র আর অন্যপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যকে ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছি বহুদূর পথ। আর বাসনা করছি এ রাস্তার শেষ সীমানা যেনো হয় পৃথিবীর শেষ প্রান্তের কাটা তারের বেড়া পর্যন্ত।
সমুদ্র আর পাহাড়ের সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে করতে ইচ্ছে জাগে পাহাড়ের খুব কাছে যাওয়ার। চান্দের গাড়িতে ব্রেক দিয়ে হিমছড়ি পাহাড়ে যাই। ২০ টাকার টিকিট কেটে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের গা ঘেষে উঠে যাই চূড়ায়। পাহাড়ের চূড়া থেকে বিশাল আকারের সমুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছিলো শিল্পী পরম যত্নে ক্যানভাসের পাতায় নীল রঙ লেপ্টে দিয়েছে।
সমুদ্রের বিশালতা আর নীলে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। মুগ্ধ হয়ে ঘুরে দেখলাম হিমছড়ি। পাহাড়ের চূড়ায় জমে উঠে আমাদের গানের আসর। সবশেষে পাহাড়ের সাথে ছবি তুলে স্মৃতি সংরক্ষণ করে সমতলে ফিরে এসে আবার যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী গন্তব্য প্রবাল পাথরের তৈরি ইনানী বিচ। ইনানী বিচে পৌঁছেই ছুটে চলি সমুদ্রের কাছে।
শহুরে জীবনের সকল ক্লান্তি, একঘেয়েমি, বিরক্তিকে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে মিশিয়ে দেই। সমুদ্র যেনো পরম যত্নে আমাদের পা ধুইয়ে দিয়ে অতিথি আপ্যায়ণ করে। আমাদের দুঃখ, কষ্টগুলো পানিতে মিশিয়ে দেয় নিমিষেই। সমুদ্র আমার সকল সুখ দুঃখের ভাগিদার। সকল অপ্রাপ্তিকে কেড়ে নিয়ে একরাশ প্রাপ্তি দিয়ে ভরিয়ে দিলো আমাকে, ফিরিয়ে দিলো প্রাণবন্ততা।
পানির গর্জনে শিহরণ জাগছিলো শরীর জুড়ে। সমুদ্র গর্জন করে কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। সমুদ্রকে প্রেম নিবেদন করেছি সেটার উত্তর হয়তো গর্জন করে দিচ্ছে আমাকে। দেখা মিললো পাথরের ফাকে ছোট্ট ছোট্ট সামুদ্রিক নাম না জানা মাছের আর ঝিনুকের। হাত দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টায় ব্যর্থ হলাম বটে তবে কয়েকটা ঝিনুক স্মৃতি হিসেবে রেখে দিলাম।
সন্ধ্যা প্রায় নামবে, হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ফেরার পথে গাড়িতে বসে দেখলাম লাল আভা ছড়িয়ে নতুন ভোরের আলোর অপেক্ষা বার্তা জানিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া। সমুদ্রের বিশালতায় হারিয়ে গেলো সূর্য। হোটেলে ফিরে রাতের খাবার সেরে বিশ্রাম নিই। রাত ১১টায় রাতের সমুদ্রকে দেখার জন্য ছুটে যাই সুগন্ধা বিচে। রাতের সমুদ্র যেনো সদ্য প্রেমে পড়া পুরুষ। রাতের বেলা সমুদ্রের গর্জন আর শীতল বাতাস যেনো সকল অনুভূতিকে হার মানায়। সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে রাতের সমুদ্রের রূপ দেখলাম।
এরপরেই জমে আমাদের সমুদ্রের পাড়ের গানের জলসা। গিটার আর উকুলেলে সুরে সুরে গান গাই। সমুদ্র যেনো গর্জন করে উৎসাহ দেয় আমাদের। রাত ৩টায় সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসি হোটেলে।
শহুরে যান্ত্রিক জীবনের সকল ক্লান্তিকে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিয়ে সঙ্গে নিয়ে গেলাম বুক ভরা নিশ্বাস আর অসংখ্য স্মৃতি। সমুদ্র আমাকে বুঝে, তাই আমিও সমুদ্রকে বুঝতে ফিরে আসতে চাই বারবার লবণাক্ত সমুদ্রে।