যে রোগটির নাম শুনলে সাধারণত সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়ে যান, সেটি হলো ক্যান্সার। এই রোগকে মরণঘাতী বলা হয়। তবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এই রোগে আক্রান্তদের বেঁচে থাকার হার সত্তর এর দশকের তুলনায় বর্তমানে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করানোর কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করা গেলে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা রোধ করা যায়।
তবে সমস্যা হচ্ছে, অনেক সময় আমরা ছোট-খাটো উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে চাই না বা সেগুলোকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিই না। এসব উপসর্গকে আমরা এড়িয়ে না গেলে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ক্যান্সার গবেষণা সংস্থার এক গবেষণা অনুযায়ী এমন কিছু সাধারণ উপসর্গ রয়েছে, যেগুলো হতে পারে ক্যান্সারের লক্ষণ। চলুন জেনে নেওয়া যাক সে সম্পর্কে-
ওজন কমে যাওয়া
ক্যান্সার আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই কোনো না কোনো সময় ওজন হারাতে শুরু করে। তাই, কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়াটা উদ্বেগের বিষয় হতে পারে। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই পাঁচ কেজি বা তার বেশি ওজন কমলে সেটি ক্যান্সারের প্রথম লক্ষণ হতে পারে। অগ্নাশয়শয়, পাকস্থলী, খাদ্যনালী বা ফুসফুসের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়ার এই লক্ষণ বেশি দেখা যায়।
জ্বর
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সবচেয়ে সাধারণ একটি উপসর্গ হচ্ছে জ্বর। অবশ্য যে স্থানে ক্যান্সার উৎপন্ন হয়েছে সেখান থেকে দেহের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়া শুরু হলে তখন প্রায়ই জ্বর দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত সবাই কোনো না কোনো সময় জ্বরে ভোগেন। বিশেষ করে যদি ক্যান্সার বা এর চিকিৎসা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে তাহলে জ্বর বেশি হয়। অনেক ক্ষেত্রে জ্বর ক্যান্সারের প্রাথমিক উপসর্গও হতে পারে। যেমন লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা।
ক্লান্তি
চরম ক্লান্তিভাব যা বিশ্রাম নেওয়ার পরও দূর হয় না। ক্যান্সার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু ক্যান্সার যেমন লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে শুরুর দিকেই ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। কোলন বা মলাশয় ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রক্তপাত হতে পারে তবে এটা সবক্ষেত্রে হয় না। এর কারণেও ক্যান্সারের সময় ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। সারাক্ষণ ক্লান্তি অনুভব করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ত্বকে পরিবর্তন
ত্বকের ক্যান্সার ছাড়াও আরও কিছু ক্যান্সার রয়েছে যাতে আক্রান্ত হলে ত্বকে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এর লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে রয়েছে-
ত্বক কালো হয়ে যাওয়া বা হাইপারপিগমেনটেশন,
ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া বা জন্ডিস,
ত্বক লাল হয়ে যাওয়া বা চুলকানি,
মাত্রাতিরিক্ত চুলের বৃদ্ধি।
অন্ত্রের ক্রিয়া বা মূত্রাশয়ের কার্যক্রমে পরিবর্তন
কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া বা আপনার মলের আকারে দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্তন মলাশয়ের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। অন্যদিকে প্রস্রাব করার সময় ব্যথা, প্রস্রাবে রক্তপাত, বা মূত্রাশয়ের কার্যক্রমে পরিবর্তন যেমন আগের তুলনায় কম বা বেশি প্রস্রাব করা ইত্যাদি মূত্রাশয় বা প্রোস্টেট ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। আগের তুলনায় কম বা বেশি প্রস্রাব করা ইত্যাদি মূত্রাশয় বা প্রোস্টেট ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
ক্ষতস্থান না শুকানো
অনেকেই জানেন যে দেহে যদি কোন আঁচিল থাকে যেটি বাড়ে বা ব্যথা হয় বা সেটি থেকে রক্তপাত হয় তাহলে সেটি ত্বকের ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে। কিন্তু শরীরে যদি কোনো ক্ষত থাকে যেটি চার সপ্তাহের পরও ভালো হয় না বা সেরে যায় না, এমন ক্ষতের প্রতিও আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। মুখে যদি এমন কোন ক্ষত হয় তাহলে সেটি মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। আপনার মুখের যেকোনো পরিবর্তন যদি দীর্ঘ সময় ধরে থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই একজন চিকিৎসক বা ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শিশ্ন বা জরায়ুতে ক্ষত বা সংক্রমণও ক্যান্সারের প্রাথমিক অবস্থার লক্ষণ হতে পারে। এমন অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রক্তপাত
ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় কিংবা তা ছড়িয়ে পড়ার পর অস্বাভাবিক রক্তপাত হতে পারে। কাশির সঙ্গে রক্তপাত ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। অন্যদিকে, যদি মলের সঙ্গে রক্তপাত হয় তাহলে এটি মলাশয় বা মলদ্বারে ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এনডোমেট্রিয়াম বা জরায়ুর আবরণে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের কারণে যোনিপথে অস্বাভাবিক রক্তপাত হতে পারে। এছাড়া মূত্রের সঙ্গে রক্ত পড়লে সেটি মূত্রাশয় বা কিডনি ক্যান্সারের কারণে হতে পারে। স্তনবৃন্ত বা স্তনের বোটা থেকে রক্ত-মিশ্রিত তরল বের হলে সেটি স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
শরীরের যেকোনো স্থান শক্ত হয়ে যাওয়া
অনেক ক্যান্সার ত্বকের মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে। এ ধরণের ক্যান্সার সাধারণত স্তন, অণ্ডকোষ, গ্রন্থি এবং শরীরের নরম টিস্যুতে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেহে শক্তভাব বা মাংস জমে আছে- এ ধরণের অনুভূতি হয়। এটা এসব ক্যান্সারের প্রাথমিক বা বিলম্বিত উপসর্গ হতে পারে।
খাবার গিলতে অসুবিধা
ক্রমাগত বদহজম বা কোনো কিছু গিলতে গেলে সমস্যা হলে সেটা ইসোফ্যাগাস, পাকস্থলী বা গলার ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
টানা কাশি বা কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন
টানা কাশি ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়া কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসলে তা স্বরযন্ত্র বা থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে।
সর্বোপরি, এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত উপসর্গ ছাড়াও অন্য আরও অনেক কারণেই ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। সতর্ক হোন, সুস্থ থাকুন।
সূত্র: বিবিসি অবলম্বনে
