ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতাদের পেটানোর ঘটনায় বরখাস্ত হয়েছেন।
সম্প্রতি হারুনকে নিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সাবেক এই নেতার দাবি, এডিসি হারুন ছাত্রদলকর্মী ছিলেন এবং তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
তবে এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দিনভর হারুনের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের থানাঘাটা গ্রামের স্থানীয় ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলেছে এজেড নিউজ। পাওয়া গেছে মিশ্র তথ্য। কেউ বলছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত আবার কেউ বলছেন বিএনপি-জামাতের রাজনীতি করেছেন হারুনের পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারুনের বাবা জামালউদ্দীন গাজী মাড়িয়ালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন-যাপন করছেন। হারুনের মা শেফালী বেগম একজন গৃহিণী। তাদের পুরাতন বাড়ি ছিল একই ইউনিয়নের বালিয়াখালী গ্রামে। তবে বর্তমানে তারা থানাঘাটা গ্রামে বসবাস করছেন।
হারুন তার বাবার কর্মস্থল মাড়িয়ালা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সাতক্ষীরা ডে-নাইট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ডে-নাইট কলেজে পড়াশোনার সময় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী আখতার হোসেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির (টিপু-বাদশা কমিটি) বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপসম্পাদক ছিলেন হারুন। তার ছোট ভাইয়ের নাম শরীফুল ইসলাম। তিনি সাইফুর রহমান সোহাগের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়াবিষয়ক উপ-সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। তবে তার পরিবারের আর কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
সদ্য সাবেক এডিসি হারুন যখন সাতক্ষীরায় অধ্যয়নরত ছিল, সে সময়কার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমান সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আখতার হোসেন বলেন, হারুন অর রশিদ ও তার ছোট ভাই সাতক্ষীরা ডে-নাইট কলেজের লেখাপড়া করত। সে সময় ওই কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি ছিল না, তবে তারা দুইভাই আমার সাথে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করত। এরপর তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করেছে।
হারুনের স্কুল জীবনের বন্ধু শ্যামল কুমার জানান, হারুন কলেজ ওঠার পর থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্কুল জীবনে আমরা এক ক্লাসে পড়তাম। সে একজন মেধাবী ছাত্র। চাকরি পাওয়ার পর থেকে এলাকার মানুষের বিভিন্ন সময়ে মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে।
আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রভাষক দীপঙ্কর বাছাড় বলেন, হারুন ও তার ভাই ছাত্রলীগের সাথে স¤পৃক্ত ছিল, তবে তার নানা হাজরাখালী গ্রামের বাবর আলী সানা মুসলিম লীগ ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের পরিবারের অন্যরা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এদিকে, হারুনের নিজ গ্রাম থানাঘাটার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী মোড়ল বলেন, হারুন চাকরি পাওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার পরিবার জামাত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত জাতীয় নির্বাচনে আমরা তার নানা বাড়িতে ভোট চাইতে গেলে তারা ধানের শীষে ভোট দেবে বলে আমাদেরকে জানিয়ে দেয় এবং তারা ধানের শীষের কর্মী হিসেবে কাজ করে বলে জানায়।
অপরদিকে, শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং গত ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবু হেনা সাকিল বলেন, হারুনের পরিবারের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে গত দুটি সংসদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হারুনের বাবা-মা নৌকার পক্ষে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তার নানার পরিবারের সঙ্গে জমাজমি নিয়ে বিরোধের কারণে ইউনিয়নের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন জোয়ারদার ও তার ছেলে পলাশ বিভিন্ন স্থানে তাকে জামায়াত-বিএনপি বানানোর চক্রান্ত করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম বর্ষে হারুন জিয়া হল ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তাকের ছত্র-ছায়ায় থেকে গণহলে অবস্থান করতেন। তবে তিনি সরাসরি ছাত্রদল করতেন কি না এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তিনি।
হারুনের বাবা জামালউদ্দীন গাজী বলেন, পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমার দুই ছেলে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতি করত। ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর থেকে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। মূলত গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমার স্বামী ও ছেলেরা আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুহেনা সাকিলের পক্ষে থাকায় বর্তমান স্বতন্ত্র চেয়ারম্যানের লোকজন জামায়াত বানানোর অপচেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, আমি একজন স্কুল শিক্ষক, আমার স্ত্রী আমি গৃহিণী, গ্রামে আমাদের ছোট একটি বাড়ি আছে। অনেক কষ্টে ছেলেদের পড়াশোনা শিখিয়েছি। এলাকায় আমাদের একটি বাড়ি ছাড়া অঢেল সম্পত্তি নেই। বর্তমানে আমরা ঢাকায় অবস্থান করছি। বাড়িতে তালা দিয়ে এসেছি। ছেলের বিপদের সময় যারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে অপপ্রচার করছে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।
শ্রীউলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সরদার বলেন, এডিসি হারুন সাহেব ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তার চাকরির সময়কালে আমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তার চাকরির সময় কয়েক দফায় তাকে প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছি। তবে চাকরি পেয়ে সে নিজ দলের নেতাকর্মীদের অন্যয়ভাবে মারপিট করবে এমনটি আমি আশা করিনি।