মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্পখাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট অর্ডার ১২৮ ও ১২৯ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় যথাক্রমে বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান এর যাবতীয় সম্পত্তি ও দায় নিয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠান দুইটি তাদের কার্যক্রম আরম্ভ করে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই দুইটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভুত হয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) নামে যাত্রা শুরু করে।
প্রাথমিক পর্যায়ে বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হলেও ২০১৫ সাল থেকে ব্যাংকটি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শতভাগ রাষ্ট্র মালিকানাধীন এই ব্যাংকটি জন্মলগ্ন থেকেই লাভজনকভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২২ অনুযায়ী এই ব্যাংকের মোট আয় ১৭৬.৭৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ২০২২ সালে সরকারকে শুধুমাত্র আয়কর বাবদ প্রদান করে ১৪.৮০ কোটি টাকা, ২০২১ সালে যার পরিমাণ ছিলো ১৮.৭৯ কোটি টাকা। এছাড়াও ২০২১ সালে সরকারকে স্টক ডিভিডেন্ড হিসেবে ২০০.০০ কোটি টাকা প্রদান করে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন অন্যান্য একাধিক ব্যাংক যখন মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারের শরণাপন্ন হচ্ছে সেখানে বিডিবিএলের এই অর্জন সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
শিল্পখাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকটি জন্মের পর থেকেই তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করে আসছে। ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ৫০টি শাখা (৩৩টি শহর ও ১৭টি পল্লী শাখা) নিয়ে পরিচালিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ব্যাংকটি কটন, উলেন ও সিনথেটিক টেকনোলজী খাতে ১০৪৯ টি প্রজেক্টে মোট ৫৯৪.৯০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে যা এর মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪%। খাদ্য ও খাদ্যজাত দ্রব্য খাতে ১৭৩৫ টি প্রজেক্টে ৪৫১.৬৩ কোটি টাকা ছাড়াও পাট ও পাটজাত দ্রব্যশিল্প, চামড়া শিল্প, ঔষধ ও কেমিকেল শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাংকটির মোট বিতরণ ২৪৭৯.৬৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত দেশের স্বনামধন্য বিআর স্পিনিং মিলস লিঃ, নরদার্ন ডিস্টিলারিজ লিঃ, বেক্সটার (এওয়াই) ল্যাবরেটরি, শামসুদ্দিন স্পিনিং মিলস রিঃ, উর্মি নীটওয়্যার, জড়িনা নীটওয়্যার, রংপুর ফাউন্ড্রি লিঃ (বর্তমান নাম আরএফএল), সোনারগাঁও টেক্সটাইলস লিঃ সহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, করোনা পরিস্থিতি, বৈশ্বিক ও জাতীয় অর্থনীতিতে বিপযর্য়, ব্যাংকে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব, খেলাপী ঋণ আদায়ে আদালতের দীর্ঘসূত্রিতাসহ নানাবিধ কারণে উক্ত বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৪১.৩৭% ঋণ শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে। ২০২২ সালে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১০২৫.৯০ কোটি টাকা যা ২০২৩ এসে কমে দাঁড়িয়েছে ৯৮২.০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ মার্চ, ২০২৪ তারিখে ত্রৈমাসিকান্তে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি এর শ্রেণীকৃত ঋণ কমে ৩৪% হয়। ২০২১ ও ২০২০ সালে শ্রেণীকৃত ঋণের হার ছিল যথাক্রমে ৩০.৭৭% ও ২৮.০১%। উল্লেখ্য যে, বর্ণিত খেলাপী ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষিত আছে। ব্যাংকটি খেলাপী ঋণে নিয়ে ঝুঁকিতে থাকলেও নিয়মিত নতুন ঋণ বিতরণ ও নবায়ন, আদালতের বাইরে সমঝোতার ভিত্তিতে অথবা আদালতের সহায়তায় আইনী প্রক্রিয়ায় খেলাপী ঋণ আদায়, নতুন নতুন শাখা খোলার মাধ্যমে আমানত ও ঋণের গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, সরকারী সেবাসমুহসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের মাধ্যমে গ্রাহক সেবার মানোন্নয়ন, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন যুগোপযেগী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকের খেলাপী ঋণের চিত্র ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন আনয়ন করাসহ ব্যাংকটিকে একটি আদর্শ ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। ইএফটিএন, আরটিজিএস সুবিধাসহ বিভিন্ন অনলাইল সেবা সম্বলিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ, কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে লেনদেন,এনপিএসবি লেনদেন, বিকাশ/নগদের সাথে লেনদেন, ইউটিলিটি বিল কালেকশনসহ সকল সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়াও, ডেবিট কার্ড , ই-কেওয়াইসি অ্যাপ ব্যবহার করে অনলাইনে একাউন্ট খোলার সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ইতোমধ্যে গ্রাহকের স্পর্শের সীমায় পৌছে গিয়েছে।
গত ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে ‘দ্রুত সংশোধনীমূলক কার্যক্রম’ (Prompt Corrective Action Framework) শিরোনামে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার-১৭ অনুযায়ী মূলধন ও নন-পারফর্মিং লোনের প্যারামিটারের ভিত্তিতে দেশের সকল ব্যাংকগুলোকে ৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত করার কথা বলা হয়। নির্ধারিত প্যারামিটারসমূহের মধ্যে মূলধণ সংশ্লিষ্ট ৩ টি প্যারামিটারে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ক্যাটাগরি-১ ও ২ মানে শ্রেণীভুক্ত। ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি-এর সিআরএআর এর মান ২৩.১৩% যেখানে ন্যুনতম প্রয়োজন ১২.৫%। টায়ার-১ ক্যাপিটাল রেশিও ২২.৬৭% এবং সিইটি১ ক্যাপিটাল রেশিও ২২.৬৭% যা ন্যুনতম প্রয়োজন যথাক্রমে ৬% এবং ৪.৫%। নীট এনপিএল রেশিও ২৫.৭০% যেক্ষেত্রে ন্যুনতম মান ১৪% এর কম ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ৪টি প্যারামিটারের মধ্যে ৩টিতে ক্যাটাগরি-১ এ শ্রেণীভুক্ত হলেও শুধুমাত্র ১টি প্যারামিটারে (নীট এনপিএল রেশিও) ক্যাটাগরি-৪ এ শ্রেণীভুক্ত হবার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি দুর্বল (হলুদ) তালিকাভুক্ত ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০২২ এর মান -৩.০৪ থেকে উন্নিত হয়ে জুন-২০২৩ এ -২.০৪ হয়।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি প্রতিনিয়তই উন্নতি করছে এবং এ উন্নয়নের ধারা অব্যহত থাকলে ব্যাংকটি ভবিষ্যতে প্রথম রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক হিসেবে ভাল (সবুজ) ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারে। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি-কে সোনালী ব্যাংক পিএলসি-এর সাথে একীভুত করে দিলে তা হবে ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের জন্য মৃত্যুর পূর্বেই ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার মত। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেখান থেকে একটু চেষ্টা করলেই উত্তরণ সম্ভব। সেখানে সেই চেষ্টাটুকু না করে ব্যাংকটিকে বিলুপ্ত করে দেয়া আসলে কতটুকু যৌক্তিক? তাছাড়া, এই একীভুতকরণ দেশের আর্থিক উন্নয়নে আসলে কতখানি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে সেটাও প্রশ্নের দাবীদার। একটি রাষ্ট্রিয় মালিকানাধীন ব্যাংকের বিলুপ্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশাই প্রমাণ করে।