চুল পড়া বা অকালে টাক হয়ে যাওয়া আজকাল অনেকেরই পরিচিত সমস্যা। বয়স ২৫ পেরোতেই কেউ কেউ দেখেন চুলের ঘনত্ব কমে যাচ্ছে, কেউ আবার মাথার সামনে টাকের রেখা দেখতে পাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অকালে চুল পড়ার পেছনে দায়ী শুধুমাত্র জিন নয়, বরং অনিয়মিত জীবনযাপন, মানসিক চাপ, দূষণ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও পুষ্টিহীনতাও সমানভাবে ভূমিকা রাখে। তবে কিছু নিয়মিত অভ্যাস ও সঠিক যত্ন নিলে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব।
চুল পড়ার মূল কারণগুলো জানা জরুরি-
চুল ঝরে যাওয়া রোধ করতে প্রথমে জানতে হবে এর মূল কারণ। সাধারণত অতিরিক্ত মানসিক চাপ, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং হরমোনের পরিবর্তনের কারণে চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে যায়। অনেক সময় থাইরয়েড বা রক্তস্বল্পতা থেকেও চুল পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দিনে ৫০ থেকে ১০০টি চুল পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু যদি তার বেশি পরিমাণে পড়ে যায় এবং নতুন চুল না গজায়, সেটিই বিপদের সংকেত। তাই সময়মতো কারণ শনাক্ত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষা বা হরমোন টেস্ট করিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের গুরুত্ব-
চুলের গোড়া মজবুত রাখতে হলে শরীরে প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, বায়োটিন ও ভিটামিন–ই এর ঘাটতি পূরণ করা জরুরি। মাছ, ডিম, দুধ, শাকসবজি, ডাল ও বাদাম প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত। বিশেষ করে বায়োটিন (Vitamin B7) চুলের কোষ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়া পর্যাপ্ত পানি পান চুলের জন্য উপকারী। শরীরে পানির ঘাটতি হলে চুল শুষ্ক ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। তাই প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস পানি পান করা উচিত। ক্যাফেইন ও অতিরিক্ত চিনি যুক্ত খাবার কমিয়ে প্রাকৃতিক ফলমূল বাড়ানোও সহায়ক হতে পারে।
তেল ও প্রাকৃতিক যত্নে চুলের পুনর্জীবন-
অকালে চুল পড়া রোধে প্রাকৃতিক তেলের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর। বিশেষ করে নারকেল তেল, আমলকী তেল, ক্যাস্টর অয়েল এবং অলিভ অয়েল চুলের গোড়া পুষ্টি জোগায়। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন গরম তেল দিয়ে মাথার স্ক্যাল্পে হালকা ম্যাসাজ করলে রক্তসঞ্চালন বাড়ে, যা নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
চুলে রাসায়নিক ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা উচিত। যেমন— মেহেদি, ডিমের কুসুম, অ্যালোভেরা বা মেথি বীজের পেস্ট চুলে ব্যবহার করলে চুলের পুষ্টি বাড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শ্যাম্পু করার আগে অন্তত আধা ঘণ্টা তেল লাগিয়ে রাখা এবং রাসায়নিক শ্যাম্পুর পরিবর্তে মাইল্ড হারবাল শ্যাম্পু ব্যবহার করা ভালো।
মানসিক চাপ ও ঘুমের প্রভাব-
অকালে চুল ঝরে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ মানসিক চাপ। যখন আমরা অতিরিক্ত টেনশনে থাকি, শরীরের কর্টিসল হরমোন বেড়ে যায়, যা চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। তাই নিয়মিত ধ্যান, যোগব্যায়াম বা সকালে হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
একইভাবে ঘুমের অভাবও চুলের ক্ষতি করে। প্রতি রাতে ৬-৮ ঘণ্টা পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরের হরমোন ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা চুল পড়ার কারণ হতে পারে। তাই নিয়মিত ঘুমের সময় নির্ধারণ করা ও নীল আলো থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন।
দূষণ ও স্ক্যাল্পের যত্ন-
শহুরে জীবনে ধুলাবালি ও দূষণ এখন নিত্যসঙ্গী। এই দূষণ স্ক্যাল্পে জমে রোমকূপ বন্ধ করে দেয়, ফলে চুল গজানো বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য বাইরে থেকে এসে মাথা ভালোভাবে ধোয়া, স্ক্যাল্প পরিষ্কার রাখা এবং সপ্তাহে অন্তত একদিন ডিপ ক্লিনিং করা জরুরি।
অনেকে প্রতিদিন শ্যাম্পু করেন, কিন্তু এতে প্রাকৃতিক তেল হারিয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত শ্যাম্পু না করে, প্রয়োজনে বিকল্প দিন ব্যবধান রেখে মাথা ধোয়া ভালো।
হরমোন ও চিকিৎসা-
বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণ, সন্তান জন্ম বা মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তনে চুল পড়া বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট বা ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রভাবেও টাক পড়তে দেখা যায়, যাকে অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়া বলা হয়।
চিকিৎসকরা সাধারণত মিনোক্সিডিল বা ফিনাস্টেরাইড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। তবে এসব ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আধুনিক চিকিৎসা ও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট-
যাদের ক্ষেত্রে সাধারণ যত্নে কাজ হয় না, তাদের জন্য রয়েছে আধুনিক চিকিৎসা। যেমন— PRP থেরাপি (Platelet Rich Plasma) বা হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট। PRP থেরাপিতে নিজের রক্ত থেকে প্লেটলেট আলাদা করে স্ক্যাল্পে ইনজেকশন দেওয়া হয়, যা নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট এখন জনপ্রিয় সমাধান। এতে শরীরের এক অংশের চুল অন্য অংশে প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে এটি ব্যয়বহুল এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ছাড়া করা উচিত নয়।
জীবনযাপনে পরিবর্তন আনুন-
চুল পড়া রোধ করতে হলে শুধু বাহ্যিক যত্ন নয়, অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনও জরুরি। ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ, নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম— এগুলো চুলের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
চুলের যত্নে ধৈর্যও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পরিবর্তন একদিনে আসে না, বরং নিয়মিত অভ্যাসের ফলই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দেয়।
অকালে চুল পড়া যেমন মানসিক উদ্বেগের কারণ, তেমনি তা আত্মবিশ্বাসেও প্রভাব ফেলে। কিন্তু সঠিক যত্ন, পুষ্টি ও জীবনযাপনের পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি রোধ করা সম্ভব। প্রাকৃতিক উপায়ে যত্ন নেওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক প্রশান্তিই হতে পারে ঘন ও স্বাস্থ্যকর চুলের আসল রহস্য।
চুল ঝরে যাওয়া শুরু হলে আতঙ্কিত না হয়ে কারণ খুঁজে বের করে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।