গত দশকে বাংলাদেশে স্মার্ট প্রযুক্তি প্রবেশ করে সামাজিক জীবন, ব্যবসা ও সরকারি সেবার রূপ বদলে দিয়েছে। স্মার্টফোন, মোবাইল ইন্টারনেট, ডিজিটাল অর্থপ্রণালি, স্মার্ট এগ্রিকালচার ও ই-গভর্ন্যান্সসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ব্যবহার বাড়ছে; ফলে নাগরিক সেবা দ্রুততর হয়েছে, অর্থনীতিতে নুতন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে এবং গ্রামীণ অঞ্চলেও ডিজিটাল সংযোগের সুফল দেখা যায়। তবু প্রযুক্তির বিস্তারে নানা অবকাঠামোগত, সামাজিক ও নীতিগত চ্যালেঞ্জও কুণ্ঠিত করে—যা সমাধান না করলে প্রযুক্তির প্রকৃত সুফল সমাজের সব স্তরে সমানভাবে পৌঁছে দেবে না। এই প্রতিবেদনে আমরা বাংলাদেশের স্মার্ট প্রযুক্তির বর্তমান অবস্থা, প্রধান সাফল্য, মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ এবং এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করছি।
প্রচলন ও প্রবৃদ্ধির চিত্র
বাংলাদেশে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়ছে; স্মার্টফোনে অ্যাপ ভিত্তিক ব্যাংকিং, শপিং, শিক্ষা ও বিনোদন সহজলভ্য হওয়ার কারণে ডিজিটাল লেনদেন ও অনলাইন খরচ দ্রুত বেড়েছে। সরকারি উদ্যোগ যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন, উদ্ভাবনী উদ্যোগ-হাব ও আইসিটি নীতি যুবশক্তিকে টেক-স্টার্টআপে উৎসাহিত করেছে। ফিনটেক সলিউশন—বিকাশ, নগদ ইত্যাদি—পে-টু-পল, পে-টু-মার্ট ও মাইক্রো-পেমেন্টকে সমর্থন করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়িয়েছে। শিক্ষা খাতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও রিমোট লার্নিং বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে ছাত্র-শিক্ষকদের শিক্ষা বহাল রাখতে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া স্মার্ট এগ্রিকালচার ও আইওটি-ভিত্তিক ফসল নজরদারি কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করছে।
প্রধান সাফল্য ও সামাজিক সুবিধা
প্রযুক্তি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করতে কাজ করেছে—সেলুলার সম্প্রসারণ, সাশ্রয়ী ডেটা প্যাক ও অনলাইন সেবা গ্রামীণ বাজারে ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। স্বাস্থ্যসেবায় টেলিমেডিসিন সেবা দূরবর্তী রোগী-চিকিৎসকের সংযোগ বাড়িয়েছে; কৃষিতে মোবাইল-ভিত্তিক বাজার তথ্যে চাষিরা মূল্য-উত্তেজনা এড়াতে পারছেন। সরকারী সেবায় অনলাইনে ট্যাক্স ফাইলিং, নাগরিক সনদ ও ট্রাকিং সিস্টেমে স্বচ্ছতা বাড়ায় দুর্নীতি কমাতে ভূমিকা রেখেছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের হাব—ইনকিউবেটর ও কো-ওয়ার্কিং স্পেস—স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে এবং আউটসোর্সিং ও সফটওয়্যার রপ্তানিতে দেশের অবস্থান শক্ত করেছে।
প্রধান চ্যালেঞ্জ: অবকাঠামো ও ডিজিটাল বিভাজন
তবে স্মার্ট প্রযুক্তি বিস্তারে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা সবচেয়ে বড় বাধা। গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে ব্যান্ডউইথ ও কানেকটিভিটির বৈষম্য, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অসুবিধা ও ৪জি/৫জি কভারের অসমতা ডিজিটাল সার্ভিস গ্রহণে অনিয়মিততা সৃষ্টি করে। ডিজিটাল বিভাজন—শিক্ষা, আয় ও লিঙ্গভিত্তিক—রোধে কাজে দেরি হলে সামাজিক অসমতা আরও বাড়বে। পাশাপাশি ফাইবারঅপটিক রোলআউটের গতি, টাওয়ার স্থাপনা ও ইন্টারনেট মূল্যের কৌশলগত সমাধান এখনও দরকার।
নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা সংক্রান্ত উদ্বেগ
ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে গোল বন্ধ সন্দেহজনক—সাইবার নিরাপত্তা ও ডাটা গোপনীয়তা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হচ্ছে। অনলাইন অর্থ লেনদেনে বেড়ে যাওয়া জালিয়াতি, ফিশিং হামলা ও ডাটা লিক—সবই নাগরিকের আস্থা ক্ষুণ্ন করে। সরকারি তথ্যভাণ্ডার ও ব্যক্তিগত ডাটার সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী আইন ও প্রযুক্তিগত প্রটোকল প্রয়োজন। যদিও সাইবার আইন সংক্রান্ত উদ্যোগ রয়েছে, বাস্তবায়ন, দক্ষতা ও পুনরাবৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে উন্নতি দরকার।
আইনি-নীতিগত ও নিয়মবিধির ঘাটতি
ডিজিটাল সেবার দ্রুততা ও বিস্তারে নিয়ন্ত্রক কাঠামো আপডেট করা জরুরি। প্ল্যাটফর্মে উপচে পড়া কনটেন্ট, অনলাইন হুমকি, কপিরাইট, ই-কমার্স নির্ভরতা ও পণ্য-সেবা সুরক্ষা—এসব ক্ষেত্রে স্পষ্ট নীতিমালা ও কার্যকর নজরদারি প্রয়োজন। সমসাময়িক নীতির সঙ্গে দ্রুত অভিযোজন না হলে প্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বাণিজ্য বেড়ে যাবে। এছাড়া ডেটা লোকালাইজেশন, ক্লাউড সার্ভিস রেগুলেশন ও ক্রস-বর্ডার ডাটা ফ্লো নিয়ে নীতিগত সমাধান আনার তাগিদ আছে।
মানবসম্পদ ও দক্ষতার ঘাটতি
টেক সেক্টরের দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে দক্ষ জনবল প্রস্তুত এক ধাপ পিছিয়ে আছে—সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবার সিকিউরিটি, ডেটা সায়েন্স ও আইওটি প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত কর্মীর চাহিদা বেড়েছে। উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ সংস্থাগুলোকে বাস্তবমুখী কোর্স, ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাক্সেস কো-অপ ও সার্টিফিকেশন সম্প্রসারণ করতে হবে যাতে যবতীয় সক্ষমতাসম্পন্ন কর্মশক্তি গড়ে ওঠে।
সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নাবলী
স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে সামাজিক প্রভাব—গোপনীয়তার অবক্ষয়, অনলাইন নির্যাতন, কাজের অস্থায়িত্ব ও প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত সিদ্ধান্তে পক্ষপাত—এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। অ্যালগরিদম-নির্ভর সিস্টেমে বায়াস বা ভুল সিদ্ধান্ত সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে; তাই নৈতিক ডিজাইন ও স্বচ্ছতা জরুরি। শিশু ও কিশোরদের ডিজিটাল রীতিনীতি ও কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণেও বিশেষ নীতি অপরিহার্য।
সমাধান ও সুপারিশ
প্রথমত, অবকাঠামোগত বিনিয়োগ দ্রুত বাড়াতে হবে—ফাইবার রোলআউট, টাওয়ার নেটওয়ার্ক বিস্তার ও গ্রিড স্থিতিশীলকরণ। দ্বিতীয়ত, সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো উন্নত করে জোরালো ডাটা প্রটেকশন আইন প্রয়োগ ও সাইবারফোর্স তৈরির মাধ্যমে আস্থা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে স্কুল-স্তর থেকে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাধ্যতামূলক করা, নারীদের লক্ষ্য করে প্রশিক্ষণ স্কিম এবং কমিউনিটি ডিজিটাল হাব স্থাপন জরুরি। চতুর্থত, নিয়ন্ত্রক কাঠামো হালনাগাদ করে প্ল্যাটফর্ম দায়বদ্ধতা, কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ও কনজিউমার প্রোটেকশন শক্তিশালী করতে হবে। পঞ্চমত, উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণে টেকনোলজি-ফোকাসড কোর্স বৃদ্ধির পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশে স্মার্ট প্রযুক্তির বিস্তার দেশের দ্রুত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার একটি শক্তিশালী উপায়; তবে এটি সবার জন্য ততটাই ফলপ্রসূ হবে যতটা কার্যকরভাবে অবকাঠামো, নিরাপত্তা, দক্ষতা ও নীতিগত আহ্বান মেলানো যায়। প্রযুক্তি গ্রহণে সমতা নিশ্চিত করা, গোপনীয়তা রক্ষা করা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির দিকে নজর দিলে স্মার্ট প্রযুক্তি শুধুই সুবিধাই আনবে—আর তা অর্থনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নের এক শক্তিশালী ধাক্কা হয়ে উঠবে।


