২০১৯ সালে ‘প্যারাসাইট’ নামে একটা কোরিয়ান মাস্টারপিশ সিনেমা মুক্তি পায়। এটা হল প্রথম নন ইংলিশ সিনেমা যেটা অস্কার পেয়েছিল। আসলে এতদিন ধরে শুধুমাত্র সেসব সিনেমাগুলোকেই অস্কার দেওয়া হত, যে সিনেমাগুলো আমেরিকায় ইংলিশ ভাষায় তৈরি করা হতো। কিন্তু ‘প্যারাসাইট’ হলো প্রথম এমন একটি সিনেমা, যে সিনেমাটি আমেরিকার বাইরে কোরিয়ান ভাষায় তৈরি করা হলেও এটা বেস্ট ফিচার ফিল্মের জন্য অস্কার পেয়েছিল।
‘প্যারাসাইট’ সিনেমাটা আমাদের সমাজের এমন কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে, যে বিষয়গুলো আমাদের অনেকবার অবধি ভাবতে বাধ্য করবে। সিনেমার গল্পটি শুরু হয় সাউথ কোরিয়া থেকে। সেখানে চারজন সদস্যের খুব গরিব একটা ফ্যামিলি দেখানো হয়। কিন্তু তারা গরীব হাওয়া সত্ত্বেও চারজনই খুবই ট্যালেন্টেড ছিল। কিন্তু এদের কারো কাছেই কোন কাজ ছিল না।
‘প্যারাসাইট’ সিনেমা নিয়ে নীরবে বিপ্লব ঘটে গেল অস্কারের মঞ্চে, একবার নয় বার-বার। ইংরেজি ভাষায় না হলেও এই প্রথম সেরা শিরোপা জিতে নিল ‘প্যারাসাইট’ সিনেমা। অন্যদিকে অনেকে প্রতিবাদ জানালেন পুরস্কার মঞ্চেই। তাদের দাবি ছিল এটাই, যে এবারের মনোনয়ন তালিকায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব কার্যত নেই। নেই কৃষ্ণাঙ্গ দের জায়গাও। একবার নয় প্রতিবাদও হ’ল অনেকবার।
৯২তম অ্যাকাডেমি পুরস্কার বা অস্কারের অনুষ্ঠান রবিবার রাতে অ্যামেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত হয়। সেই মঞ্চে দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক বং জুন হো সবাইকে চমকে দিয়ে সেরা ছবির শিরোপা জিতে নিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে ‘প্যারাসাইট’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন পরিচালক বং জুন হো। সর্বমোট চারটি পুরস্কার পেয়েছিলেন ছবিটি। বং-এর ছবিতে ডার্ক থ্রিলার ও কমেড়ির আঁধারে আপাদ মস্তক একটি রাজনৈতিক ভাষ্য দেখানো হয়েছিল।
প্যারাসাইট সিনেমাতে খুবই আশ্চর্য দক্ষতার সাথে গরীব মানুষের সঙ্গে বড়লোকদের সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার সাথে খুবই সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে কিভাবে মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব। তা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে প্রচন্ড বিতর্ক হয়েছিল ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর। আবার চলচ্চিত্র সমালোচক’দের মনও জিতে নিয়েছিল এই ‘প্যারাসাইট’ সিনেমাটি। পরিচালক বং জুস অস্কারের আগেই বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিলেন। তবে আমরা এটাও জানি যে একাডেমী পুরস্কারের ওজন সব সময়ই বেশি থাকে। বিশেষজ্ঞরা অবাক হয়ে বলছেন, যে অ-ইংরেজি ছবি হয়েও যে ‘প্যারাসাইড’ সিনেমা সেরা ছবির পুরস্কার নিয়ে নিল তা অভূতপূর্ব।
সিনেমা হয়েছে বিভিন্ন ভাষায় ধনী পরিবারের পরিচয় ভাঁড়ীয়ে চাকরি করতে যাওয়ার গল্প নিয়ে। ভারতীয় অসংখ্য সিনেমা সেই থিম নিয়ে। একটু বাংলা’তে ছদ্দবেশী বা দেয়া নেয়ার কথা ভেবে দেখুন উদাহরণ হিসেবে। আবার অনেকেই এই সিনেমাটিকে তামিল সিনেমার সাথে ও তুলনা করছেন। কিন্তু আসলেই সে তুলনা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয়। আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বিভাজন, শ্রেণী গুলির আন্তঃক্রিয়া এবং পরজৈবিক নির্ভর-শীলতা কেন্দ্রীয় বিষয় বস্তু প্যারাসাইটে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক বং জুস।
সারা বিশ্ব জুড়েই মানুষ বিরাট ভাবে একটি চিন্তা করছেন যে ক্যাপিটালিস্ট সমাজের এই উপস্থাপনাকে নিয়ে। গিগ ইকোন’মি, হায়ার এবং ফায়ার সিস্টেমের রমরমার সাথে মূল্য বোধের অবক্ষয়ের কোরিলেশন নিয়েও বোধহয় প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে অনেকটা। অনেক উচ্চতায় যেখানে সূর্য লোক অকাতর এবং নিচু তলায় গন্ধ জাপটে ধরে না সেখানে পৌঁছানো, এবং থীত হওয়ার এক সর্বগ্রাসি আকাঙ্ক্ষা এবং সব হারানোর আশঙ্কা মূল্যবোধের শরীরে বাসা বেঁধে নাই।
নিচু তলায় কোটিপতিরা মানুষের শ্রম টুকু শুষে নেয় অর্থের বিনিময়ে, যেন তাদের কাছে শ্রমটুকুই প্রয়োজনীয়, মানুষগুলি নয়। ‘প্যারাসাইট’ সিনেমাতে দেখানো হয়েছে এমন একটি সমাজ, যেখানে বহু মানুষ বেকারত্ব বা কর্মহীন। সেখানে শুধুমাত্র একটি নিরাপত্তা রক্ষীর চাকরির জন্য ৫০০ গেজুয়েট আবেদন পত্র জমা দেওয়া হয়েছিল, তবুও মেলেনি চাকরি। সিনেমা নয় একটু বাস্তব জীবনে এসে দেখুন তো চেনা চেনা লাগে কিনা?
যে দেশে কর্মহীন বেকারত্বের হার আকাশ ছোঁয়া, যে দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অসংখ্য মানুষ প্রতি নিয়ত কাজ হারাচ্ছেন, জমা পড়ছে হাতেগোনা কয়েকটি পোষ্টের জন্য অসংখ্য আবেদন পত্র। ‘প্যারাসাইট’ সিনেমাটি দেখার পর নিজের দিকে এবং চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখা নিতান্তই প্রয়োজন। হয়তো বা দিবাস্বপ্নর প্রয়োজনীয়তাও তখন বোঝা যাবে কতটা মূল্যবান।


