সময়টি ১৯৯২ সাল। বরেণ্য নির্মাতা এহতেশাম চলচ্চিত্রে নিয়ে এলেন সুন্দর মুখশ্রীর মেয়ে নূপুরকে। কাকরাইলের সিনেমাপাড়া থেকে শুরু করে এফডিসি- সব জায়গাতেই এই কিশোরীকে নিয়ে আলোচনা। সেই আলোচনার কেন্দ্রে থাকা নূপুরই আজকের নন্দিত অভিনেত্রী শাবনূর। চলতি মাসেই অভিনয় ক্যারিয়ারের তিন দশক পার করেছেন তিনি। ১৯৯৩ সালের ১৫ অক্টোবর মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘চাঁদনী রাতে’। যদিও ব্যবসায়িকভাবে সফলতার মুখ না দেখলেও শাবনূরের অভিনয় প্রশংসিত হয়। ফলে হাতে আসতে থাকে নতুন নতুন ছবি। ‘স্বপ্টেম্নর ঠিকানা’ যেন তাঁর ক্যারিয়ার গ্রাফ বদলে দিল। রচিত হলো নতুন গল্প। এরপর চলচ্চিত্রের আকাশে উড়তে থাকলেন শাবনূর। ঢাকাই চলচ্চিত্রের অসংখ্য দর্শকপ্রিয় ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। এরপর একের পর এক হিট ছবি উপহার দিতে থাকেন এই পর্দার রানী। ঢাকাই চলচ্চিত্র জগৎ হঠাৎ তাঁর জন্যই যেন আসন পেতে রেখেছিল।
একসময় চলচ্চিত্রের পর্দায় প্রাণময়তা ধরে রেখেছিলেন শাবনূর। চলচ্চিত্রে যেন নতুন হাওয়ার ঝাপটা হয়ে এসেছিলেন। কেবলই নৃত্যে পারদর্শী এক গ্ল্যামারগার্ল ইমেজের মধ্যে সীমিত ছিলেন না তিনি। বিচিত্র ধরনের চরিত্রে ছিলেন সাবলীল। প্রায় দুই দশক পর্দায় সৌন্দর্যের সমার্থক ছিলেন। বরেণ্য অভিনেত্রী শাবানার পর আর কোনো নায়িকাকে এত দীর্ঘ সময়জুড়ে প্রভাববলয় অক্ষুণ্ণ রাখতে দেখা যায়নি। বাংলা চলচ্চিত্রে একমাত্র অভিনেত্রী যিনি, প্রায় দুই দশক নায়িকার চরিত্রে কাজ করেছেন। যাঁকে কেন্দ্র করে গল্প নির্বাচন করতেন নির্মাতারা। ঢালিউডের নায়কনির্ভর ইন্ডাস্ট্রিতে দাপটের সঙ্গে অভিনয় দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছেন শাবনূর। সময়ের প্রায় সব নায়কের সঙ্গেই জুটি বেঁধে কাজ করেছেন।
প্রয়াত নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে দর্শক তাঁকে বেশি গ্রহণ করেছেন। তিনি শুধু প্রেমের ছবিতে অভিনয় করেননি; অভিনয় করেছেন এমন কিছু সিনেমায়, যার কারণে দর্শক তাঁকে যুগ থেকে যুগান্তরে মনে রাখবেন। ২০১৩ সাল থেকে চলচ্চিত্রে অনিয়মিত একসময়ের নন্দিত এই নায়িকা। ২০০০ সালের শুরু থেকে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ছোট বোনের কাছে থাকছিলেন। একসময় সেখানকার নাগরিকত্বও পান। এর পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘদিন প্রবাসজীবন পার করছেন তিনি। সর্বশেষ এই অভিনেত্রী দেশে এসেছিলেন ২০২০ সালে। লম্বা সময় পর্দায় না থাকলেও এখনও তাঁর জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি। পর্দায় না পেয়ে অনুরাগীরা তাঁকে খুঁজে ফেরেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শাবনূরও ফেসবুক আইডি, পেজ, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে নিয়মিত কাজের আপডেট দিয়ে ভক্ত ও দর্শকের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হওয়া শাবনূরের কেমন যাচ্ছে দিনকাল? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ অনেকেরই। সম্প্রতি সমকালের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ কলে শাবনূর বলেন, ‘ছেলে আইজানই আমার পৃথিবী। ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। বোন ঝুমুরের সঙ্গও বেশ উপভোগ করছি। কিছু ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছি। বাড়ির আঙিনায় বিশাল এলাকায় সবজির বাগান রয়েছে। সেখানে শীতকালীন লাউ, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, শিম, বেগুন থকে শুরু করে নানা ধরনের সবজির চাষ করছি; যা সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে অনেকেই দেখেছেন। সব মিলিয়ে সময় ভালোই যাচ্ছে। শাবনূর সর্বশেষ মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘এত প্রেম এত মায়া’ নামে একটি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। গেয়েছেন সিনেমার একটি গানও। তবে এখন পর্যন্ত ছবিটির শুটিং শেষ করেননি এই অভিনেত্রী। সময়-সুযোগ পেলেই দেশে এসে ছবির দৃশ্যধারণে অংশ নেবেন তিনি।
বর্তমানে দেশে ও দেশের বাইরে অনলাইন মাধ্যমগুলোর ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে, যার কারণে বেড়েছে অভিনয়শিল্পীদের কদর। সে কারণে অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধা মনে করছেন, সিনেমায় না হলেও শাবনূর হয়তো ওটিটিতে ফিরবেন। শাবনূর যে মাপের অভিনেত্রী তাতে করে তাঁকে কিন্তু এই মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারেন। দেশের চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের পাশাপাশি সাধারণ ভক্তরাও চান, শাবনূর অভিনয়ে ফিরে আসুক। অভিনয়ে ফিরবেন কি তিনি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি খোলাসা করে বললেন, ‘দেখুন, বিদেশে থাকলেও মনটা সব সময় দেশে পড়ে থাকে। এখনও অভিনয়ের ইচ্ছা রয়েছে। আমাকে প্রাধান্য দিয়ে তেমন গল্পের সিনেমা ও কিংবা ওটিটির বড় কোনো কাজে নির্মাতারা আগ্রহী হন, তাহলে অবশ্যই কাজে ফিরব।
শুধু অভিনয়ই নয়, অনেকেই জানেন আমার পরিচালনায় আগ্রহ রয়েছে। ২০০৫ সালে ছোট বোন ঝুমুরের গাওয়া বেশ কিছু মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেছিলাম। তখন তো শখে কাজটি করেছি। সিরিয়াস কিছু ভেবে করিনি। ওই সময় অনেকেই বলেছেন আমাকে পরিচালনায় আসতে। এ নিয়ে তখন কিছু না ভাবলেও এখন মাঝেমধ্যে পরিচালনার বিষয়টি মাথায় আসে। সবকিছু মিলে গেলে পরিচালনাও করার ইচ্ছা রয়েছে।’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের তিন দশক সময় পার করেছেন। পেছনে ফিরে তাকালে কী দেখতে পান? ‘মাঝেমধ্যে নিজের কাছে প্রশ্ন করি, এতগুলো বছর পার হলো কী করে! অথচ যেদিন কাজ করেছি, সেদিন মোটেও ভাবিনি এত লম্বা সময় পাড়ি দিতে পারব। সবার ভালোবাসার শাবনূর হয়ে থাকব।
ক্যারিয়ারে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। নায়কের সঙ্গে প্রেমগুঞ্জন। ব্যক্তিগত জীবনে আমার ওপর অনেক ঝড় গেছে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে মোকাবিলা করেছি। এখনও মনে পড়ে এহতেশাম দাদুর কথা। তিনি স্বপ্টম্ন দেখাতেন। তাঁর দেখানো স্বপ্টেম্নর পথ ধরেই হেঁটেছি এতটা পথ। ফেলে আসা কর্মব্যস্ত দিনগুলো খুব মিস করি। এমন শত শত দিন গেছে, সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে ঢাকা থেকে রওনা হয়েছি। ১০টার আগেই চলে এসেছি গাজীপুর কিংবা পুবাইলের শুটিং স্পটে। শুটিং থেকে আসার পথে দুই চোখের পাতা এক করে কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিয়েছি। যাত্রাপথেই যেটুকু ঘুম হয়েছে। দর্শকদের ভালোবাসার শাবনূর হতে পেরেছি বলে এসবই এখন সুখস্মৃতি। সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় এখনও যথেষ্ট সম্মান নিয়েই আছি আমি। চলচ্চিত্রের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অভিনয়ের সুবাদে অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। তাই আলাদা করে বাড়তি কিছু পাওয়ার কথা কখনও ভাবিনি। শিল্পীজীবনে মানুষের ভালোবাসা বড় প্রাপ্তি বলে মনে করি।’
চলচ্চিত্রের অন্তঃপ্রাণ মানুষটি অভিনয় থেকে দূরে থাকলেও চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে ভাবেন। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রে অভিনয় না করলেও খোঁজ-খবর নিয়মিত রাখি। এখন সিনেমার সংখ্যা খুবই কম। এ বিষয়টিতে সবার নজর দেওয়া উচিত। কীভাবে ভালো মানের সিনেমার সংখ্যা বাড়ানো যায়, এ নিয়ে চিন্তা করা দরকার। তবে আশার কথা হচ্ছে, এখন বিশ্বজুড়ে আমাদের সিনেমার দর্শক বেড়েছে। প্রবাসীরা বাংলা সিনেমা দেখছেন। বাংলাদেশের সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত বেশ কয়েকটি ছবি বিভিন্ন দেশে মুক্তি পেয়েছে। দর্শক ছবিগুলো খুব উৎসাহ নিয়ে দেখেছেন। সমন্বিতভাবে সবাই কাজ করলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আমি মনে করি।’
তথ্যসূত্র- দৈনিক সমকাল


