মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য প্রকৃতির সবচেয়ে বড় উপহার। জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত নবজাতকের জন্য মায়ের দুধই হতে পারে সর্বোত্তম খাদ্য, যা শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকা রাখে। তবে অনেক সময় দেখা যায়, নতুন মায়েরা সঠিকভাবে নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়ম সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখেন না। এতে শিশুর পরিপূর্ণ পুষ্টি পাওয়া ব্যাহত হয়। তাই নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক নিয়ম জানা প্রতিটি মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করার সঠিক সময়-
বিশেষজ্ঞরা জানান, শিশুর জন্মের পরপরই বা অন্তত প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। প্রথম দুধ, যাকে কলোস্ট্রাম বলা হয়, তা শিশুর জন্য সবচেয়ে উপকারী। এতে থাকে প্রচুর অ্যান্টিবডি যা নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে এবং ভবিষ্যতের অনেক সংক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক ভঙ্গি-
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মাকে আরামদায়ক অবস্থায় বসতে বা শুতে হবে। শিশুকে মায়ের বুকের সমান উচ্চতায় আনতে হবে এবং তার মাথা ও ঘাড় সঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে হবে। শিশুর মুখ মায়ের স্তনের বোঁটার পুরো চারপাশ ঢেকে ফেললে সেটাই সঠিকভাবে দুধ খাওয়ানোর লক্ষণ। এভাবে খাওয়ালে শিশুর পেট ভরে এবং মায়ের স্তনে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
কতক্ষণ দুধ খাওয়ানো উচিত-
প্রতিটি স্তন থেকে শিশুকে অন্তত ১০-১৫ মিনিট দুধ খাওয়ানো জরুরি। অনেক সময় মায়েরা ভাবেন, কয়েক মিনিট দুধ খাওয়ালেই যথেষ্ট। কিন্তু আসলে স্তনের শেষ অংশের দুধে বেশি পরিমাণে চর্বি থাকে, যা শিশুর ওজন বাড়াতে সহায়তা করে। তাই প্রতিবার খাওয়ানোর সময় শিশুকে এক স্তন শেষ করে অন্য স্তনে দিতে হবে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর ফ্রিকোয়েন্সি-
জন্মের পর প্রথম কয়েক সপ্তাহে নবজাতককে দিনে ৮-১২ বার দুধ খাওয়ানো প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা অন্তর তাকে দুধ খাওয়াতে হবে। শিশুর কান্না বা অস্থিরতা দেখে দুধ খাওয়ানোর সময় নির্ধারণ না করে, নির্দিষ্ট বিরতিতে নিয়মিত খাওয়ানোই সবচেয়ে ভালো।
দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের যত্ন-
নবজাতককে দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি মায়ের নিজের স্বাস্থ্যেরও যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার এবং পর্যাপ্ত পানি পান করলে মায়ের দুধের উৎপাদন বাড়ে। এছাড়া মানসিক চাপ কম রাখা এবং ধূমপান বা অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা জরুরি।
বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা-
মায়ের দুধ শুধু শিশুর জন্য নয়, মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। এটি শিশুকে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানের সংক্রমণ, এমনকি ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ও স্থূলতার মতো রোগ থেকেও সুরক্ষা দেয়। অন্যদিকে মায়েদের ক্ষেত্রে স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় এবং সন্তান জন্মের পর শরীর দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ-
চিকিৎসকরা বলেন, নবজাতকের জন্য বুকের দুধই হলো সম্পূর্ণ খাবার। প্রথম ছয় মাস কোনোভাবেই শিশুকে পানি, মধু, ফর্মুলা মিল্ক কিংবা অন্য কোনো খাবার দেওয়া উচিত নয়। ছয় মাস পর ধীরে ধীরে পরিপূরক খাবার শুরু করা যায়, তবে অন্তত দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ চালিয়ে যেতে হবে।
নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো শুধু একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি শিশুর সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে দেয়। তাই সঠিক নিয়ম জানা এবং নিয়মিতভাবে তা পালন করা প্রতিটি মায়ের দায়িত্ব। বুকের দুধ শিশুর জীবনের প্রথম বিনিয়োগ, যা তাকে আজীবন সুস্থ, সবল ও বুদ্ধিমান হতে সাহায্য করবে।