বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ইদুর (Rat/Mouse) ব্যবহারের ইতিহাস বহু দশক প্রাচীন। ছোট আকার, দ্রুত প্রজনন, মানুষের জীববিজ্ঞানের সঙ্গে অনুরূপতা এবং ল্যাবরেটরিতে সহজে পালনযোগ্য হওয়ার কারণে ইদুরকে গবেষণার আদর্শ প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুধু এই বৈশিষ্ট্যগুলোই নয়, ইদুরের ব্যবহার চিকিৎসা, জেনেটিক্স, ফার্মাকোলজি, নিউরোসায়েন্স এবং পরিবেশ বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার এবং পরীক্ষার ভিত্তি তৈরি করেছে।
১. ওষুধ ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণা
ইদুর বিভিন্ন রোগের মডেল তৈরি এবং ওষুধ পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগের নতুন ওষুধের কার্যকারিতা প্রাথমিকভাবে ইদুরের ওপর পরীক্ষা করা হয়। ভ্যাকসিন ও প্রতিষেধক পরীক্ষা করাও ইদুর দিয়ে করা হয়, কারণ এর শরীরের প্রতিক্রিয়া মানুষের সঙ্গে তুলনীয়। এছাড়া নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনেও ইদুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. জেনেটিক্স ও জিনোম গবেষণা
ইদুরের জিনোম মানুষের সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে। তাই ইদুর ব্যবহার করে গবেষকরা জিন পরিবর্তন, জেনোম এডিটিং (যেমন CRISPR প্রযুক্তি) পরীক্ষা করতে পারেন। জেনেটিক রোগের মডেল তৈরি, জিনের প্রভাব বোঝা এবং রোগের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্য ইদুর অপরিহার্য। এই গবেষণার মাধ্যমে মানব জীবনের জেনেটিক সমস্যাগুলো বোঝা এবং সমাধানের পথ তৈরি হয়।
৩. নিউরোসায়েন্স ও মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণা
ইদুরের মস্তিষ্ক এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্য মানুষের সঙ্গে তুলনীয় হওয়ায় নিউরোসায়েন্স গবেষণায় ব্যবহার হয়। আলঝেইমার, পারকিনসন, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগের পরীক্ষায় ইদুরের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। এছাড়া স্মৃতি, শেখার ক্ষমতা এবং মস্তিষ্কে মাদক বা স্ট্রেসের প্রভাব বোঝার জন্য ইদুর অপরিহার্য।
৪. পরিবেশ ও টক্সিকোলজি পরীক্ষা
ইদুর ব্যবহার করে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, খাদ্যসাপ্লিমেন্ট বা পরিবেশগত দূষণের প্রভাব বোঝা যায়। এর মাধ্যমে মানব দেহে সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব, বিষাক্ত পদার্থের নিরাপদ মাত্রা এবং পরিবেশগত ঝুঁকি নির্ধারণ করা যায়। টক্সিকোলজি গবেষণায় ইদুরের তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৫. প্রজনন ও বৃদ্ধি সম্পর্কিত গবেষণা
ইদুর দ্রুত প্রজনন করতে পারে এবং শরীরের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দিকে মানুষের সঙ্গে মিল থাকে। গবেষকরা প্রজননশীলতা, হরমোনজনিত রোগ, বৃদ্ধি ও জীবনচক্র নিয়ে ইদুরের ওপর পরীক্ষা করে। এই তথ্য শিশু ও গর্ভকালীন স্বাস্থ্য গবেষণায় ব্যবহার করা হয়।
৬. অন্যান্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা
ইদুর শুধু ওষুধ ও স্বাস্থ্য গবেষণায় নয়, উদ্ভাবনী বিজ্ঞান, বায়োটেকনোলজি এবং খাদ্য বিজ্ঞানেও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রযুক্তি বা চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগের আগে প্রাথমিক পরীক্ষা ইদুরের ওপর করা হয়, কারণ এটি মানুষের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সঠিক তথ্য দেয়।
ইদুর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় একটি অপরিহার্য প্রাণী। ওষুধ ও চিকিৎসা, জেনেটিক্স, নিউরোসায়েন্স, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং প্রজনন গবেষণায় ইদুরের ব্যবহার মানুষের রোগ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে গবেষণার সময় প্রাণীর কল্যাণ, নৈতিকতা এবং বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।