বিশ্বস্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ দেখায়,উপযুক্ত হাইড্রেশন সুস্থতার একটি মূল ভিত্তি। কিন্তু প্রশ্নটি যে কত লিটার পানি প্রতিদিন পান করা উচিত, তার একক ও সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই; বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক পরিশ্রম, আবহাওয়া ও স্বাস্থ্যের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে পানি চাহিদা পরিবর্তিত হয়। তবু সাধারণ নির্দেশিকা ও গবেষণার উপর ভিত্তি করে নাগরিকদের জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ দেওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক সুপারিশ অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মোট দৈনিক তরল প্রায় ৩.৭ লিটার এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মোট দৈনিক তরল প্রায় ২.৭ লিটার। এখানে “মোট তরল” বলতে বোঝায় পানীয় জল, চা-কফি, দুধ, ফলের রস ইত্যাদি এবং খাবার থেকে প্রাপ্ত জল,সব মিলিয়ে মোট পরিমাণ। বাস্তবে সরাসরি খালি পানির লক্ষ্য হিসেবে সাধারণত পুরুষরা প্রায় ২.৫–৩ লিটার এবং নারীরা প্রায় ২–২.৫ লিটার খাঁটি পানি পান করলে বেশিরভাগ মানুষের জন্য যথেষ্ট থাকে।
শিশু ও কিশোরদের পানির চাহিদা আলাদা। এক থেকে তিন বছরের শিশুদের জন্য মোট তরল প্রায় ১.৩ লিটার, চার থেকে আট বছর বয়সীদের জন্য প্রায় ১.৭ লিটার এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিকভাবে বাড়ে কিশোরী প্রায় ২.৩ লিটার ও কিশোর পুরুষ প্রায় ৩.০ লিটার মোট তরল প্রয়োজন হতে পারে। গর্ভবতী ও স্তনদানকারী নারীদের জন্য মোট তরল যথাক্রমে প্রায় ৩.০ লিটার ও ৩.৮ লিটার সুপারিশ করা হয়; কারণ এই সময় অতিরিক্ত জলের প্রয়োজন হয়।
পানি কেন জরুরি তা বোঝা অপরিহার্য: পানি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টি পরিবহন, বর্জ্য উপাদান নির্গমন, কিডনি ও কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত পানি না পেলে হালকা থেকে মাঝারি ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ দেখা যায় মাথাব্যথা, ক্লান্তি, মনোযোগ কমে যাওয়া ও প্রস্রাব কমে যাওয়া; গুরুতর হলে নাড়ির অনিয়ম বা অজ্ঞান অবস্থাও হতে পারে। অন্যদিকে অত্যধিক পানি পান করলে রক্তে সোডিয়ামের ঘাটতি (হাইপোন্যাট্রেমিয়া) হতে পারে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
শারীরিক কাজ ও আবহাওয়ার প্রভাব বড় ভূমিকা রাখে। ভারী পরিশ্রম, তীব্র ব্যায়াম বা গরম-আর্দ্র পরিবেশে ঘাম-মিশ্রণে শরীর থেকে বেশি পানি নষ্ট হয়,এক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি এবং ইলেকট্রোলাইট (যেমন সোডিয়াম) প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। আমাদের দেশের গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা থাকার ফলে সাধারণ ধারণার ওপর প্রায় ০.৫–১.০ লিটার বাড়তি পানি যোগ করা যেতে পারে; ব্যায়ামের পর ইলেকট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয় উপকারী হতে পারে।
বয়স ও রোগের ওপর নির্দিষ্ট সতর্কতা আছে। বয়স্কদের তৃষ্ণা কম অনুভূত হওয়ার ফলে তারা সহজেই ডিহাইড্রেশনের শিকার হতে পারেন; কিডনি, হার্ট বা লিভারের মতো জটিল রোগ থাকলে অতিরিক্ত পানি অনাকাঙ্ক্ষিত হতে পারে, এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি। ডায়ালিসিস, ডায়ুরেটিক ওষুধ গ্রহণকারীদেরকেও পানির পরিমাণ врачের নির্দেশ অনুযায়ী সামঞ্জস্য করতে হবে।
দৈনন্দিন ব্যবহারে সহজ নিয়মগুলো কার্যকর: সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি পান করুন, প্রতিটি খাবারের আগে ও পরে ছোট করে পানি নিন এবং ব্যায়াম বা গরমে অতিরিক্ত পানি রাখুন। প্রস্রাবের রং একটি সহজ নির্দেশক , হালকা হলুদ বা প্রায় স্বচ্ছ রং থাকলে হাইড্রেশন ঠিক আছে; গাঢ় হলুদ হলে আরও পানি দরকার। কফি ও চা গ্রহণ করলে তাদের ডায়ুরেটিক প্রভাব পুরোপুরি পানি ক্ষয় করে না, তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইন হলে সঙ্গে অতিরিক্ত পানি রাখা ভালো।
প্রতিষ্ঠানিক ও জনস্বাস্থ্য দিক থেকে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। কর্মস্থলে নিয়মিত পানীয় বিরতি ও পরিচ্ছন্ন পানির সহজলভ্যতা কর্মদক্ষতা বাড়ায়। স্কুলে শিশুদের জন্য পানি বোতল ব্যবহার ও নিরাপদ পানীয়জল নিশ্চিত করলে ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ সম্ভব। গ্রাম ও শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় নিরাপদ পানীয়জলের অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য প্রচার কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
গবেষণা ও নীতিনির্ধারকের দিক থেকে বলা যায়,কিছু ব্যক্তিরা অনায়াসে অতিরিক্ত পানি পান করেন, আবার অনেকে তাদের ব্যক্তিগত চাহিদামতো পান না। জনস্বাস্থ্য প্রচারণায় ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী যেমন শিশু, গর্ভবতী মা, বৃদ্ধ ও ক্ষয়শীল শ্রমিকদের লক্ষ্য করে নির্দেশনা দিলে কার্যকারিতা বাড়বে। ভবিষ্যতে বায়োমার্কার ও ব্যক্তিগত হাইড্রেশন মাপকাঠি ব্যবহারের মাধ্যমে আরও নির্দিষ্ট পরামর্শ প্রদান সম্ভব হবে।
প্রতিদিন কত লিটার পানি পান করা উচিত,এর একক উত্তর নেই; তবু আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মোট তরল প্রায় ৩.৭ লিটার এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মোট তরল প্রায় ২.৭ লিটার সমানভাবে কার্যকর নির্দেশনা দেয়। কার্যকরভাবে খাঁটি পানির লক্ষ্যমাত্রা পুরুষ ২.৫–৩.০ লিটার এবং নারী ২.০–২.৫ লিটার ধরে চললে অধিকাংশ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত হবে; তবে গর্ভাবস্থা, তীব্র শারীরিক কাজ, উচ্চ তাপমাত্রা, বয়স ও নির্দিষ্ট রোগে এই পরিমাণ বাড়ানো বা কমানো প্রয়োজন। নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যের সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং প্রস্রাবের রং ও শারীরবৃত্তীয় লক্ষণ দেখে নিজেই হাইড্রেশন নিয়ন্ত্রণ করুন।