খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) কুরাইশের অন্যতম শীর্ষ নেতা ওয়ালিদের পুত্র। ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই তিনি আরব সমাজে এক বীর সেনানায়ক ও অতুলনীয় কৌশলবিদ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। বদরের যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেননি, তবে ওহুদের যুদ্ধে মুশরিকদের পক্ষে লড়েছিলেন। উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের সাময়িক পরাজয়ে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খালিদ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন ৮ হিজরির সফর মাসে, হুদায়বিয়া সন্ধির পর এবং মক্কা বিজয়ের আগে। হুদায়বিয়া চুক্তির পরের বছর আল্লাহর রাসুল ﷺ যখন ওমরাহ পালন করতে মক্কায় আগমন করেন, তখন তিনি খালিদের সম্পর্কে জানতে চান। নবিজি ﷺ খালিদ ইসলাম গ্রহণ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। নবিজির এই আগ্রহের কথা তার ভাই ওয়ালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) একটি চিঠির মাধ্যমে তাকে জানান, যা খালিদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তার অন্তরে ইসলামের প্রতি প্রবল আকর্ষণ জন্ম দেয়।
বায়হাকি (রহ.) বর্ণনা করেন, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) বলেন— “যখন আল্লাহর রাসুল ﷺ ওমরাহ করতে মক্কায় আসেন, আমি তখন আত্মগোপনে ছিলাম। আমার ভাই ওয়ালিদ ইবনে ওয়ালিদ তখন ইসলামের অনুসারী হয়ে নবিজির সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাকে খুঁজে না পেয়ে চিঠি লিখে পাঠান। তিনি লিখেছিলেন, ‘তুমি ইসলামের মতো সত্যকে কীভাবে অগ্রাহ্য করছ? আল্লাহর রাসুল ﷺ তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছেন এবং বলেছেন— খালিদ কোথায়? আমি বলেছি, আল্লাহ তাকে নিয়ে আসবেন। নবিজি ﷺ বলেছেন, ওর মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তি কীভাবে ইসলামের মতো সত্যকে উপেক্ষা করতে পারে? যদি সে তার যোগ্যতা মুসলমানদের কাজে লাগাতো, তা তার জন্য অনেক কল্যাণকর হতো, আমি তাকে অন্যদের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতাম। সুতরাং, হে আমার ভাই! যা তোমার হাতছাড়া হয়েছে তা পূরণ করো, তুমি অনেক কল্যাণকর সুযোগ হারিয়েছ।’ এই চিঠি আমার অন্তরে ইসলামের প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করে।”
ইবনে কাসির (রহ.) আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-তে এবং জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রহ.) খাসায়েসুল কুবরা-য় উল্লেখ করেছেন, খালিদ (রা.) বলেন— “যখন আল্লাহ আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারণ করলেন, তখন তিনি আমার অন্তরে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করলেন। আমি নিজেকে বললাম, আমি মুহাম্মাদ ﷺ-এর বিরুদ্ধে এত যুদ্ধ করেছি, কিন্তু প্রতিবারই আমি ফিরে এসেছি এই অনুভূতি নিয়ে যে, আমি ভুল করছি, আর মুহাম্মাদ ﷺ অবশ্যই বিজয়ী হবেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর আমি ভাবতে লাগলাম, এখন আমি কোথায় যাব? হাবশার বাদশাহ নাজাশির কাছে যাবো? তিনি তো মুহাম্মাদ ﷺ-কে গ্রহণ করেছেন। রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে যাবো? তাহলে তো আমাকে ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে। আমি এই চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।”
তিনি আরও বলেন— “এই অবস্থায় আমি জানতে পারি, নবিজি ﷺ ওমরাহ পালন করতে মক্কায় এসেছেন। আমি আত্মগোপনে ছিলাম এবং ভাই ওয়ালিদ আমাকে খুঁজে না পেয়ে আবারও একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিতে তিনি লিখলেন, ‘ইসলামের সত্যতা অস্বীকার করা তোমার মতো বুদ্ধিমান মানুষের জন্য বিস্ময়কর। নবিজি ﷺ তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছেন এবং বলেছেন, খালিদ কোথায়? আমি বললাম, আল্লাহ তাকে নিয়ে আসবেন। তখন তিনি বললেন, ওর মতো বুদ্ধিমান কি ইসলামকে না বুঝে থাকতে পারে? যদি সে তার শক্তি ও সাহস ইসলামের পক্ষে ব্যবহার করতো, তবে আমি তাকে অগ্রাধিকার দিতাম। সুতরাং, হে আমার ভাই, যা হাতছাড়া হয়েছে তা পূরণ করো, তুমি অনেক কল্যাণ হারিয়েছ।’”
চিঠিটি তার অন্তরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে যখন তিনি শুনলেন যে নবিজি ﷺ তার কথা জানতে চেয়েছেন, তখন তার হৃদয় আনন্দে ভরে যায় এবং ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার সঙ্গে আলোচনা করেন, কিন্তু সফওয়ান কঠোরভাবে অস্বীকার করেন। এরপর ইকরিমা ইবনে আবু জাহলের কাছেও প্রস্তাব দেন, সেও প্রত্যাখ্যান করে। পরে উসমান ইবনে তালহার সঙ্গে দেখা হলে তিনি রাজি হন। পরদিন ভোরে তারা একত্রে মদিনার উদ্দেশে রওনা হন। পথে আমর ইবন আস (রা.)-এর সঙ্গে দেখা হয়, তিনিও ইসলাম গ্রহণের জন্য মদিনা যাচ্ছিলেন।
তারা একসাথে মদিনায় পৌঁছান ৮ হিজরির সফর মাসে। নবিজি ﷺ তাদের আগমনের খবর শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হন। খালিদ (রা.) বলেন— “আমি আমার সেরা পোশাক পরে নবিজির ﷺ কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে হাসলেন। আমি সালাম দিলে তিনি হাসিমুখে জবাব দিলেন। আমি বললাম, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল। নবিজি ﷺ বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, যিনি তোমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। আমি সবসময় আশা করেছিলাম, তোমার বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা তোমাকে কল্যাণের দিকেই নিয়ে যাবে।’
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি অতীতে আপনার বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ করেছি, আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নবিজি ﷺ বললেন, ‘ইসলাম পূর্বের সব গুনাহ মুছে দেয়।’ আমি আবার বললাম, সত্যিই কি তাই? তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ, খালিদের পূর্বের সব পাপ ক্ষমা করে দিন, যা কিছু সে আপনার পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য করেছে।’ এরপর উসমান ও আমর (রা.) নবিজির হাতে বাইআত গ্রহণ করেন।”
খালিদ (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর থেকে ইসলামের একনিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে নিজেকে নিবেদন করেন। তিনি অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অদ্বিতীয় বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মুতার যুদ্ধে তিনি সাধারণ সৈনিক হিসেবে অংশ নেন। ঐ যুদ্ধে তিনজন সেনাপতি পরপর শহীদ হলে খালিদ (রা.) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং অসাধারণ কৌশলে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন। শত্রু সেনারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। সেই যুদ্ধে তার নয়টি তলোয়ার ভেঙে গিয়েছিল।
তার এই সাহসিকতায় নবিজি ﷺ তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তরবারি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। নবিজি ﷺ তার সম্পর্কে বলেন— “আল্লাহর এক উত্তম বান্দা, খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ, আল্লাহর তরবারি।”
(সুনানে তিরমিজি)
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, নবিজি ﷺ বলেছেন— “খালিদ আল্লাহর তরবারি, আল্লাহ তাকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে উন্মুক্ত করেছেন।”
ইসলামের ইতিহাসে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) এক অনন্য বীর, যিনি ইসলামপূর্ব যুগে ছিলেন ইসলামের শত্রু, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর আল্লাহর পথে নিজের জীবন, শক্তি ও মেধা নিবেদন করে হয়ে ওঠেন ইসলামের এক অবিনাশী প্রতীক— ‘আল্লাহর তরবারি’।