আজ ১১ অক্টোবর, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস। দিনটি কেবল উদযাপনের নয়—এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি কন্যা শিশুই অধিকার, মর্যাদা ও সুযোগের দিক থেকে সমান। সমাজের প্রতিটি স্তরে মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ এই দিনটি।
২০১১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১১ অক্টোবরকে “আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১২ সাল থেকে দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—কন্যা শিশুদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা, তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা এবং শিক্ষায় ও প্রযুক্তিতে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা।
কন্যা শিশুর অধিকার রক্ষায় চ্যালেঞ্জ;
যদিও গত কয়েক দশকে মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে, তবুও এখনো কন্যা শিশুরা নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, দারিদ্র্য, এবং সামাজিক কুসংস্কারের কারণে মেয়েদের স্বপ্ন থেমে যায় অকালেই।
বাংলাদেশে এখনো অনেক পরিবারে অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক চাপের কারণে মেয়েদের স্কুল থেকে নামিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। এতে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, আর সমাজ হারায় এক সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) জানিয়েছে, বিশ্বে প্রতি ৫ জন মেয়ের মধ্যে ১ জন ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এই হার আশঙ্কাজনক। এর ফলে কন্যা শিশুরা শুধু শিক্ষা হারায় না, শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সরকারের উদ্যোগ ও সাফল্য;
বাংলাদেশ সরকার কন্যা শিশুর উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, মেয়েদের জন্য বিনা বেতনের শিক্ষা, উপবৃত্তি কর্মসূচি এবং নারী উন্নয়ন নীতি—এসব উদ্যোগ কন্যাদের শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলেছে।
তাছাড়া নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত। এখন মেয়েরা শুধু শিক্ষকতা বা নার্সিংয়ে নয়, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, তথ্যপ্রযুক্তি এমনকি উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে।
কন্যা শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য;
এ বছরের আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য—“শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে কন্যার সমান অংশগ্রহণ”। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি-ভিত্তিক দক্ষতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই মেয়েদের প্রযুক্তি শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
যদি কন্যা শিশুরা ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনী চিন্তায় উৎসাহ পায়, তাহলে তারা ভবিষ্যতের কর্মবাজারে নেতৃত্ব দিতে পারবে।
পরিবার ও সমাজের ভূমিকা;
শুধু সরকারের উদ্যোগে নয়, কন্যা শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমাজ ও পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের ভেতরে মেয়েকে ছোট করে দেখা, ছেলেকে বেশি স্বাধীনতা দেওয়া, কিংবা মেয়ের ইচ্ছাকে অবহেলা করা—এসব মানসিকতা বদলাতে হবে।
একটি শিক্ষিত ও নিরাপদ সমাজ গড়তে হলে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে কন্যা শিশুর প্রতি সম্মান ও সমর্থন।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা;
কন্যা শিশুরা সমাজের পরিবর্তনের চালিকা শক্তি। তাদের মধ্যে রয়েছে সীমাহীন সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা এবং নেতৃত্বগুণ। তাদের বিনিয়োগ মানেই একটি দেশের অগ্রগতি। তাই প্রয়োজন শিক্ষা, পুষ্টি, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিতে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।
আজকের কন্যা শিশুরাই আগামী দিনের মা, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী ও নীতিনির্ধারক। তাদের হাতেই ভবিষ্যতের সমাজ গড়ে উঠবে। তাই সময় এসেছে কন্যা শিশুদের প্রতি সবধরনের বৈষম্য, সহিংসতা ও অবহেলা বন্ধ করে তাদের জন্য এক উজ্জ্বল আগামী নির্মাণের।
কন্যা শিশুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শুধু আজকের জন্য নয়, প্রতিদিনের জন্য হওয়া উচিত। তাদের অধিকার রক্ষা, শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার মধ্য দিয়েই আমরা সত্যিকার অর্থে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।