সুখময় দাম্পত্য জীবনে সংসার পরিণত হয় জান্নাতের এক টুকরোতে। কিন্তু মনোমালিন্য, রাগ-অভিমান ও ঝগড়ায় সেই সংসার হয়ে ওঠে দুর্বিষহ যাতনা। ইসলাম সংসার টিকিয়ে রাখাকে উৎসাহিত করেছে এবং তালাককে করেছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কাজ। তবে নিরুপায় অবস্থায় তালাক দেয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম।
‘তালাক’ আরবি শব্দ। এর অর্থ ত্যাগ করা, বন্ধনমুক্ত করা বা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। ইসলামি পরিভাষায় বিশেষ শব্দের মাধ্যমে বিয়ের বন্ধন ছিন্ন করাকে তালাক বলা হয়।
ইসলাম স্বামীকে পরামর্শ দিয়েছে যেন স্ত্রীর অবাধ্যতা বা কোনো ভুল আচরণ দেখেই উত্তেজিত না হয়। বরং ধৈর্য ধারণ করে মিষ্টি ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের আহ্বান দিয়েছে ইসলাম। যদি এভাবে সমাধান না হয়, তবে স্বামী স্ত্রী থেকে সাময়িকভাবে আলাদা থাকবে, অর্থাৎ একত্রে রাতযাপন থেকে বিরত থাকবে। এতে যদি স্ত্রী নিজের আচরণে পরিবর্তন আনে, তাহলে সংসার পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
যদি তাতেও সমস্যা থেকে যায়, তখন উভয় পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মাধ্যমে সালিশ করা হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টির আশঙ্কা করো, তবে পুরুষের পরিবার থেকে একজন সালিশ ও নারীর পরিবার থেকে একজন সালিশ পাঠাও। তারা যদি মীমাংসা করতে চায়, তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে দেবেন।”
— সূরা আন-নিসা: ৩৫
যখন সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং সংসার রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন ইসলাম স্বামীকে তালাক দেয়ার অনুমতি দেয়। তবে এটি ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণিত ও অপছন্দনীয় কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহর নিকট বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত হলো তালাক।”
— আবু দাউদ, হাদীস: ২১৭৮
তালাক দেয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো স্ত্রী যখন মাসিক থেকে পবিত্র হবে, তখন সহবাস ছাড়া সুস্পষ্টভাবে একবার তালাক দেয়া। হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়া নিষিদ্ধ, কারণ সে সময় আবেগের কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বামী যদি এক তালাক দেয় এবং ইদ্দতের সময় স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়, তবে পুনরায় তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম হয়ে যাবে। আর যদি ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেয়, তাহলে নির্দিষ্ট সময় শেষে সম্পর্ক স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
ইসলাম একসঙ্গে তিন তালাক দেয়াকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। এতে পুনর্মিলনের সুযোগ থাকে না, এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়েই পরে অনুতপ্ত হয়। তাই ইসলাম ধীরে, চিন্তাভাবনা করে ধাপে ধাপে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে।
ইসলামে তালাকের অধিকার মূলত স্বামীর হাতে রাখা হয়েছে। নারীদের সাধারণত আবেগপ্রবণতার কারণে ছোটখাটো বিষয়ে তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, এজন্য তাদের হাতে তালাকের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তবে নারীদের জন্যও ন্যায়সংগতভাবে বিচ্ছেদের পথ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। স্ত্রী চাইলে বিয়ের সময় শর্ত সাপেক্ষে তালাকের অধিকার গ্রহণ করতে পারে, টাকার বিনিময়ে তালাক চাইতে পারে (যা খুলা নামে পরিচিত), কিংবা প্রয়োজনে বিচারকের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে।
অনেকে মনে করেন, তালাক কার্যকর হতে সাক্ষীর উপস্থিতি জরুরি—এ ধারণা ভুল। সাক্ষীর প্রয়োজন হয় বিয়ের সময়, তালাকের সময় নয়। স্বামী একা তালাক দিলেও তা কার্যকর হয়। আবার অনেকে মনে করেন গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে তা কার্যকর হয় না—এটিও ভুল ধারণা। গর্ভাবস্থায় তালাক দিলেও তা বৈধ ও কার্যকর হয়।
তালাক কোনো রাগ বা উত্তেজনার মুহূর্তের সিদ্ধান্ত নয়। ইসলাম চায় স্বামী-স্ত্রী বোঝাপড়া, ধৈর্য, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন রক্ষা করুক। তাই তালাক যেন হয় সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর চিন্তাপূর্ণ ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত, তা-ই ইসলামের নির্দেশনা।


