স্মার্টফোন এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিনের অভ্যাস, অবস্থান, সার্চ ইতিহাস থেকে শুরু করে ব্যাংকিং তথ্য—সবকিছুই আজ একটিমাত্র ডিভাইসে সংরক্ষিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা যেসব তথ্য ফোনে দিচ্ছি, সেগুলো কোথায় যাচ্ছে? কে বা কারা সেগুলো ব্যবহার করছে? উত্তরটা অনেক সময় আমাদের অজানাই থেকে যায়।
বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে প্রতিটি স্মার্টফোন এক একটি “ডেটা সংগ্রাহক যন্ত্র” হিসেবে কাজ করছে। যখনই কেউ একটি অ্যাপ ব্যবহার করে, লোকেশন অন করে বা অনলাইনে কিছু সার্চ দেয়, সেই তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, গুগল, ফেসবুক বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে তার আচরণ, আগ্রহ ও পছন্দ নির্ধারণ করে। এর ফলেই দেখা যায়, আপনি একবার কোনো পণ্যের নাম সার্চ দিলে পরবর্তী কয়েকদিন সেটি বিভিন্ন অ্যাপে বিজ্ঞাপন হিসেবে সামনে আসে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবহারকারীর ডেটা এখন বিশ্ব অর্থনীতির এক বড় সম্পদ। বিভিন্ন কোম্পানি এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বাজার কৌশল তৈরি করে, আবার অনেক সময় এই তথ্য তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রিও করা হয়। ফলে ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই তার ব্যক্তিগত তথ্য অর্থনৈতিক পণ্যে পরিণত হচ্ছে।
কিন্তু এই ডেটা ব্যবহারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বড় এক ঝুঁকি-ডেটা ফাঁস ও সাইবার অপরাধ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বহু স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর তথ্য হ্যাকারদের হাতে চলে গেছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসওয়ার্ড, এমনকি ব্যক্তিগত ছবি পর্যন্ত ফাঁস হয়েছে ইন্টারনেটে। নিরাপত্তাহীন অ্যাপ, ফিশিং লিংক কিংবা ম্যালওয়্যারের মাধ্যমেই এসব ঘটছে বলে মনে করেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
এ অবস্থায় ব্যবহারকারীর সচেতনতা বাড়ানোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করেন প্রযুক্তিবিদরা। তারা পরামর্শ দেন-অ্যাপ ইনস্টল করার আগে পারমিশন পরীক্ষা করা, অজানা লিংক না খোলা, দুই ধাপে নিরাপত্তা (টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন) চালু রাখা, এবং সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট রাখার। পাশাপাশি, পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারে সতর্ক থাকা ও প্রাইভেসি সেটিংস নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্ব দিতে বলেন তারা।
ডেটা সুরক্ষায় বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে বেশ কিছু আইন চালু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের “GDPR” (General Data Protection Regulation) এখন একটি আন্তর্জাতিক মডেল হিসেবে কাজ করছে। এতে বলা হয়েছে, ব্যবহারকারীর স্পষ্ট অনুমতি ছাড়া কোনো কোম্পানি ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ বা ব্যবহার করতে পারবে না। বাংলাদেশেও বর্তমানে ডেটা প্রোটেকশন আইন প্রণয়নের কাজ চলছে, যাতে নাগরিকদের অনলাইন তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন যতই কঠোর হোক, সচেতন ব্যবহারকারীর দায়িত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্মার্টফোন আমাদের সুবিধা বাড়িয়েছে, কিন্তু অসচেতন ব্যবহারে তা হয়ে উঠতে পারে নিজেরই বিপদ।
প্রযুক্তি আমাদের উন্নতির প্রতীক হলেও, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা এখন সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। তাই এখনই সচেতন হওয়ার সময়—কারণ আজকের পৃথিবীতে তথ্যই সবচেয়ে বড় সম্পদ, আর সেটার নিয়ন্ত্রণই নির্ধারণ করে কতটা নিরাপদ আমরা ডিজিটাল যুগে।


