নারীদের জন্য ‘চ্যালেঞ্জিং’ পেশা /

জামালপুরে স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বে মাসুমা আক্তার

আবদুল লতিফ লায়ন জেলা প্রতিনিধি, জামালপুর
জামালপুরে স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বে মাসুমা আক্তার
মাসুমা আক্তার

নারীদের জন্য অনেকটাই অপ্রচলিত পেশা স্টেশনমাস্টারের দায়িত্ব। সেই দায়িত্বই মাসুমা আক্তার পালন করছেন জামালপুর রেলস্টেশনে। মানুষ ‘চ্যালেঞ্জিং’ পেশা বললেও তিনি আর দশটা পেশার মতোই নিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে অন্য স্টেশনমাস্টারের মতো তিনিও মাসে ১০ দিন ‘নাইট শিফটে’ দায়িত্ব পালন করেন। স্টেশনে বসে ট্রেন আসা-যাওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণের কাজটি উপভোগ করছেন তিনি।

জামালপুর সদর উপজেলার রশিদপুর ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামে মাসুমার বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল। ইচ্ছা ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সরকারি চাকরি করার চিন্তাও ছিল। কিন্তু রেলওয়ে বিভাগের চাকরির বিষয়টি কখনো মাথায় ছিল না। হঠাৎ রেলওয়ে বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। কিন্তু তখন তাঁর সন্তান ছোট। একদিকে সংসার আবার ছোট্ট সন্তান। ফলে অনেকটাই দ্বিধা–দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যান তিনি। পরে স্বামী মো. আজিম উদ্দিনের উৎসাহে আবেদন করেন। ২০১৯ সালে সহকারী স্টেশনমাস্টার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।

সম্প্রতি জামালপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। স্টেশন অফিসে নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাচ্ছেন মাসুমা। আবার যাত্রীদের নানা রকম তথ্য ও ট্রেনের খবর দিচ্ছেন। আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশন অতিক্রমের সময় চলে যাওয়ায় যাত্রীদের চাপে আরও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি। টেলিফোনে অন্য স্টেশনে খবর নিচ্ছেন কোথায় আছে ট্রেনটি। সেই তথ্য আবার যাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।

ব্যস্ততার এক ফাঁকে কথা হয় মাসুমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, নারী হয়ে স্টেশনমাস্টার হিসেবে চাকরির বিষয়টি প্রতিবেশীসহ অনেকে ভালোভাবে নিচ্ছিলেন না। মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা বোধ করেছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কর্মদক্ষতা দিয়ে সবকিছু নিজের মতো করে নিলেন। এক মাস জামালপুরের নান্দিনা রেলস্টেশনে প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। আরও কিছু প্রশিক্ষণের পর পুরোদমে কাঁধে নেন সহকারী স্টেশনমাস্টারের দায়িত্ব। আড়াই বছর ধরে জামালপুর রেলস্টেশনে সহকারী স্টেশনমাস্টার হিসেবে কর্মরত। তাঁকে প্রতি মাসে ১০ দিন রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালন করতে হয়।

মাসুমা আক্তার বলেন, ‘এতে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না; বরং কাজটাকে উপভোগ করছি। স্টেশনের অন্য সহকর্মীরাও আমাকে সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। কখনো কোনো ধরনের বেকায়দায় পড়তে হয়নি। তবে প্রথম দিকে রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালনের সময় অনেকটাই টেনশন (দুশ্চিন্তা) করতাম। এখন সেটাও হয় না। পরিবার সামলিয়ে ভালোভাবেই স্টেশনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। ইচ্ছা শক্তি থাকলে সব ধরনের ভয় আর বাধা একজন নারীর সামনে কিছু নয়।’মাসুমা আক্তার জামালপুর সদর উপজেলার রশিদপুর এনইউ সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ও জামালপুরের বেলটিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেছেন। সহকারী স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বের পরিধি সম্পর্কে মাসুমা বলেন, ‘স্টেশনে এসে ট্রেন অপারেশন, সিগন্যাল মেনটেইন করি। ট্রেনের টিকিট বিক্রি করি। পাস থ্রো সিগন্যাল দিই। যাত্রীদের ট্রেন আসা-যাওয়ার তথ্য দিই। এই লাইনে চলাচল করা ট্রেনগুলো কখন কোথায় আছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করি।’

উদাহরণ দিয়ে মাসুমা বলেন, ‘যেমন ধরুন, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ১২টার মধ্যে স্টেশনে প্রবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু আজকে ট্রেনটি অনেকটাই দেরি করছে। আমি ট্রেনটির বর্তমান অবস্থান জানতে অন্য স্টেশনে ফোন করি। সেই তথ্য যাত্রীদের জানাই। আবার আমি ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের সংবাদটি পার্শ্ববর্তী স্টেশনে জানিয়ে দিই। স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ ও যাওয়ার জন্য ক্লিয়ারেন্স দিই।’

মাসুমা আক্তার জানালেন, আগের প্রযুক্তিতে সিগন্যালে অনেক সময় ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকত। তবে এখন সব কম্পিউটারাইজড হয়ে যাওয়ায় ভুল হয় না বললেই চলে। বুঝতে পারলে কাজগুলো অনেক সহজ। এ জন্য রেলওয়ে বিভাগ থেকে অনেক প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে।২০০৯ সালে মাসুমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর চাকরি নিয়েছেন। একটি সন্তান আছে তাঁর। সন্তানটি জামালপুর জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। কাজে আসার পর সন্তানের দেখভাল করার কাজের সহযোগিতা করছেন স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সব মিলিয়ে রেলস্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজে কোনো সমস্যা বোধ করছেন না বলে জানালেন তিনি। মাসুমার ভাষায়, ‘এই দেশের যেকোনো চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে কাজ করতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। বিভিন্ন পেশায় প্রচুর পরিমাণে নারীরা যুক্ত হলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যাবে।’

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জামালপুরে স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বে মাসুমা আক্তার

জামালপুরে স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বে মাসুমা আক্তার
মাসুমা আক্তার

নারীদের জন্য অনেকটাই অপ্রচলিত পেশা স্টেশনমাস্টারের দায়িত্ব। সেই দায়িত্বই মাসুমা আক্তার পালন করছেন জামালপুর রেলস্টেশনে। মানুষ ‘চ্যালেঞ্জিং’ পেশা বললেও তিনি আর দশটা পেশার মতোই নিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে অন্য স্টেশনমাস্টারের মতো তিনিও মাসে ১০ দিন ‘নাইট শিফটে’ দায়িত্ব পালন করেন। স্টেশনে বসে ট্রেন আসা-যাওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণের কাজটি উপভোগ করছেন তিনি।

জামালপুর সদর উপজেলার রশিদপুর ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামে মাসুমার বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল। ইচ্ছা ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সরকারি চাকরি করার চিন্তাও ছিল। কিন্তু রেলওয়ে বিভাগের চাকরির বিষয়টি কখনো মাথায় ছিল না। হঠাৎ রেলওয়ে বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। কিন্তু তখন তাঁর সন্তান ছোট। একদিকে সংসার আবার ছোট্ট সন্তান। ফলে অনেকটাই দ্বিধা–দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যান তিনি। পরে স্বামী মো. আজিম উদ্দিনের উৎসাহে আবেদন করেন। ২০১৯ সালে সহকারী স্টেশনমাস্টার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।

সম্প্রতি জামালপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। স্টেশন অফিসে নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাচ্ছেন মাসুমা। আবার যাত্রীদের নানা রকম তথ্য ও ট্রেনের খবর দিচ্ছেন। আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশন অতিক্রমের সময় চলে যাওয়ায় যাত্রীদের চাপে আরও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি। টেলিফোনে অন্য স্টেশনে খবর নিচ্ছেন কোথায় আছে ট্রেনটি। সেই তথ্য আবার যাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।

ব্যস্ততার এক ফাঁকে কথা হয় মাসুমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, নারী হয়ে স্টেশনমাস্টার হিসেবে চাকরির বিষয়টি প্রতিবেশীসহ অনেকে ভালোভাবে নিচ্ছিলেন না। মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা বোধ করেছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কর্মদক্ষতা দিয়ে সবকিছু নিজের মতো করে নিলেন। এক মাস জামালপুরের নান্দিনা রেলস্টেশনে প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। আরও কিছু প্রশিক্ষণের পর পুরোদমে কাঁধে নেন সহকারী স্টেশনমাস্টারের দায়িত্ব। আড়াই বছর ধরে জামালপুর রেলস্টেশনে সহকারী স্টেশনমাস্টার হিসেবে কর্মরত। তাঁকে প্রতি মাসে ১০ দিন রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালন করতে হয়।

মাসুমা আক্তার বলেন, ‘এতে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না; বরং কাজটাকে উপভোগ করছি। স্টেশনের অন্য সহকর্মীরাও আমাকে সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। কখনো কোনো ধরনের বেকায়দায় পড়তে হয়নি। তবে প্রথম দিকে রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালনের সময় অনেকটাই টেনশন (দুশ্চিন্তা) করতাম। এখন সেটাও হয় না। পরিবার সামলিয়ে ভালোভাবেই স্টেশনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। ইচ্ছা শক্তি থাকলে সব ধরনের ভয় আর বাধা একজন নারীর সামনে কিছু নয়।’মাসুমা আক্তার জামালপুর সদর উপজেলার রশিদপুর এনইউ সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ও জামালপুরের বেলটিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেছেন। সহকারী স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বের পরিধি সম্পর্কে মাসুমা বলেন, ‘স্টেশনে এসে ট্রেন অপারেশন, সিগন্যাল মেনটেইন করি। ট্রেনের টিকিট বিক্রি করি। পাস থ্রো সিগন্যাল দিই। যাত্রীদের ট্রেন আসা-যাওয়ার তথ্য দিই। এই লাইনে চলাচল করা ট্রেনগুলো কখন কোথায় আছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করি।’

উদাহরণ দিয়ে মাসুমা বলেন, ‘যেমন ধরুন, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ১২টার মধ্যে স্টেশনে প্রবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু আজকে ট্রেনটি অনেকটাই দেরি করছে। আমি ট্রেনটির বর্তমান অবস্থান জানতে অন্য স্টেশনে ফোন করি। সেই তথ্য যাত্রীদের জানাই। আবার আমি ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের সংবাদটি পার্শ্ববর্তী স্টেশনে জানিয়ে দিই। স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ ও যাওয়ার জন্য ক্লিয়ারেন্স দিই।’

মাসুমা আক্তার জানালেন, আগের প্রযুক্তিতে সিগন্যালে অনেক সময় ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকত। তবে এখন সব কম্পিউটারাইজড হয়ে যাওয়ায় ভুল হয় না বললেই চলে। বুঝতে পারলে কাজগুলো অনেক সহজ। এ জন্য রেলওয়ে বিভাগ থেকে অনেক প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে।২০০৯ সালে মাসুমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর চাকরি নিয়েছেন। একটি সন্তান আছে তাঁর। সন্তানটি জামালপুর জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। কাজে আসার পর সন্তানের দেখভাল করার কাজের সহযোগিতা করছেন স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সব মিলিয়ে রেলস্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজে কোনো সমস্যা বোধ করছেন না বলে জানালেন তিনি। মাসুমার ভাষায়, ‘এই দেশের যেকোনো চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে কাজ করতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। বিভিন্ন পেশায় প্রচুর পরিমাণে নারীরা যুক্ত হলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যাবে।’

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Download
ঠিকানা: পূর্ব কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ নিবন্ধনের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত