গত বুধবার রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কর্মরত যুগ্ম সচিব এনামুল হকের উপস্থিতিতেই সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। যুগ্ম সচিব অফিসে যাওয়ার পথে জেসমিনকে সামনে পেয়ে র্যাবের টহলদলকে প্রতারণায় সম্পৃক্ততার বিষয়ে অভিযোগ করেন। এ সময় তাঁর সামনেই অভিযুক্ত নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এদিকে মামলা ছাড়া কারো অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করতে পারে কি না—এ প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে গতকাল কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে আটক নারীর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্তে যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেডিক্যাল রিপোর্ট পেলে সব ‘ক্লিয়ার’ হবে। এ বিষয়ে আদালতও আমাদের কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন। সেগুলো আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতে জানাব।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘যুগ্ম সচিবের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে প্রতারণার অভিযোগে জেসমিনকে আটক করা হয়। যুগ্ম সচিবের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে একটি চক্র ফেক আইডি ব্যবহার করে তাঁর নামে চাকরি দেওয়া এবং বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতারণার মাধ্যমে আদায় করে আসছিল। এই অভিযোগে তিনি ২০২২ সালের মার্চে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। একই অভিযোগে ওই যুগ্ম সচিব আদালতেও মামলা করেন। যুগ্ম সচিব র্যাবের কাছে এই অভিযোগ করেন যে গত ১৯ ও ২০ মার্চ তাঁর নিজ কার্যালয়ের সামনেই তাঁর নাম ব্যবহার করে প্রতারকচক্র অর্থ প্রতারণা করে। এই খবর পেয়ে তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে প্রতারণায় আল আমিন নামের একজনের যোগসাজশ রয়েছে। এরপর তিনি খবর পান যে জেসমিন নামের এক নারীও এর সঙ্গে জড়িত। জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় র্যাবের নারী সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এর সাক্ষী ওই যুগ্ম সচিব। তাঁর সামনেই জেসমিনকে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আটক করা হয়। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদকালে আটক জেসমিন সব অভিযোগ স্বীকার করেন। তাঁর মোবাইল ফোন চলমান অবস্থায় এনামুল হকের নামে খোলা ফেক ফেসবুক আইডি দেখা যায়। তাঁর মোবাইল ফোনে সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের তথ্য পাই, যেখানে লাখ লাখ টাকা জমা রসিদের তথ্য পাওয়া যায়। এরপর জব্দ আলামত নিয়ে একটি কম্পিউটারের দোকানে প্রিন্ট করা হয়। এরপর সেখান থেকে থানায় মামলার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে ওই নারী অসুস্থবোধ করেন। তখন র্যাব তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
কমান্ডার মঈন বলেন, ‘দুপুর ১টার দিকে আমরা তাঁকে নওগাঁ হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার পর তিনি গাড়ি থেকে নিজে নেমে হেঁটে হাসপাতালে ঢোকেন। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাঁর বোন, ফুফু ও চাচাকে ডাকা হয়। এমনকি ভূমি অফিসে তাঁর সহকর্মী ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকেও (ল্যান্ড) ডাকা হয়। তাঁদের উপস্থিতিতেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। সন্ধ্যার দিকে তাঁকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে সিটি স্ক্যান করে তাঁর স্ট্রোকের আলামত পাওয়া যায়। এরপর তাঁকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এক দিন পর তিনি মারা যান। উনার কী কারণে মৃত্যু হয়েছে, সেখানে চিকিত্সকরা তা উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি পোস্টমর্টেমেও পাওয়া যাবে।’
কমান্ডার আল মঈন বলেন, ‘জেসমিনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে আমরা যুগ্ম সচিব এনামুল হককে বলি, আপনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে থানায় যান। তিনি নিজে বাদী হয়ে তখন মামলা করেন।’
প্রসঙ্গত, গত বুধবার সকাল ১০টার দিকে সুলতানা জেসমিনকে অফিসে যাওয়ার পথে র্যাব সদস্যরা একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে গত শুক্রবার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। জেসমিনের স্বজনদের অভিযোগ, নির্যাতনের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে ঘটনার শুরু থেকেই র্যাবের পক্ষ থেকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।’
র্যাবের এখতিয়ার জানতে চান হাইকোর্ট : মামলা ছাড়া কারো অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করতে পারে কি না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কাউকে গ্রেপ্তারের এখতিয়ার র্যাবের আছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়ার রিট শুনানিতে গতকাল এই প্রশ্ন তোলেন আদালত।
জেসমিনকে আটকের পর সম্মানজনক জায়গায় (থানা অথবা কার্যালয়ে) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কি না এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের ব্যবহার আইনানুগ হয়েছে কি না, হাইকোর্ট সে প্রশ্নও রেখেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কাছে। আগামী ৫ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখে এ সময়ের মধ্যে এসব প্রশ্ন সংক্রান্ত আইন, নথি এবং সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ ও র্যাবের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ।
দুপুর আড়াইটায় শুনানি শুরু হলে রিটকারী আইনজীবী আবেদনের আরজি তুলে ধরেন। শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘কোনো অনুমানের ভিত্তিতে আমরা ঘটনাটি বিবেচনা করব না। আটকের পর তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করার কথা। সেটি কিন্তু প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, জিজ্ঞাসাবাদ পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। তাঁর মাথায় আঘাতের কথা বলা হচ্ছে। দেশবাসীর প্রশ্ন, তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছিল কি না। বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। তার জন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আমরা দেখতে চাই। তা ছাড়া র্যাব গঠন-নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত আইনটিও দেখতে চাই যে সেই আইনে র্যাবকে কী কী এখতিয়ার, ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেতে চাই যে মামলা ছাড়া কারো কোনো অভিযোগে র্যাব কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারে কি না। স্বীকারোক্তি নিতে পারে কি না।’
আদালত বলেন, ‘কেউ যেন ভিকটিমাইজ না হয়, সে জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কাজও সেটি। কোনো নাগরিক যত জঘন্য অপরাধই করুক না কেন, তার জন্য আইন আছে, বিচার আছে এবং অপরাধীর বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সবার জন্যই প্রযোজ্য। এই মৃত্যুতে মামলা করা হবে কি হবে না সেটা রাষ্ট্র এবং ওই নারীর আত্মীয়-স্বজনের বিষয়। আমাদের জানা দরকার যে তাঁর মৃত্যু কিভাবে হয়েছে।’
হেফাজতে মৃত্যু মারাত্মক অপরাধ : র্যাবের হেফাজতে নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা একটি মারাত্মক অপরাধ এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়।
এ ছাড়া বলা হয়, র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত ব্যক্তির পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যুর ঘটনা কমিশনের কাছে অস্বাভাবিক মর্মে প্রতীয়মান হয়। এ অবস্থায় হেফাজতে মৃত্যুসংক্রান্ত বর্ণিত অভিযোগের বিষয়টি র্যাব বাদে পুলিশের অন্য কোনো ইউনিটের মাধ্যমে তদন্ত করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রেরণ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে বলা হয়েছে।
জেসমিনের হাতেও আঘাত ছিল : সুলতানা জেসমিনের আঘাত শুধু মাথায় নয়, তাঁর হাতেও পাওয়া গেছে জখম। সুরতহাল প্রতিবেদনেই বিষয়টি উঠে এসেছে। এ প্রতিবেদনে শুধু হাতের বাইরের আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ আছে। তবে ময়নাতদন্তের সময় চিকিৎসকরা দেখেছেন, হাতের ভেতরে মাংসে জমাট বেঁধে ছিল রক্ত।
জেসমিনের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার জেসমিন আক্তার। তিনি বলেন, মাথা ছাড়াও জেসমিনের ডান হাতের কনুইয়ের কাছে তিনি আঘাত দেখেছেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে এসব আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) মর্গে তিনজন চিকিৎসকের একটি বোর্ড ময়নাতদন্ত করে। এই দলের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন জানান, ডান হাতে বাহুর নিচে এবং কনুইয়ের কাছে একটা কালশিরা জখম ছিল। ময়নাতদন্তের সময় তাঁরা ওই স্থানের মাংসে জমাট বাঁধা রক্ত দেখেছেন।
নওগাঁয় চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতির শোক : সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় নওগাঁ জেলা চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতির এক জরুরি সভায় গতকাল শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সুলতানা জেসমিন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তিন মাস্টার্স পাস ছিলেন। তবু তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার কোনো দিন দেখিনি। আমার মনে হয়, তিনি যে বেতন পেতেন তাতে তাঁর টানাটানি ছিল। চাঁদা চাইলে সব সময় দিয়ে উঠতে পারতেন না।’
সূত্র: প্রথম আলো