অর্থনীতির গতিবিধি বোঝা যায় কিছু সূচক দিয়ে। ভালো সময়ে সেগুলো ইতিবাচক অবস্থায় থাকে। খারাপ সময়ে যায় মন্দার দিকে। গত অর্থবছরের শুরু থেকেই এসব সূচক নিন্মমুখী হতে শুরু করে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, দেশে ডলার সংকট, শিল্প খাতে মন্দা, আমদানি ও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমা, বিনিয়োগ আশানুরূপ না হওয়া, রাজস্ব আহরণে ভাটাসহ নানা সূচকে নিন্মমুখী প্রবণতা দেখা দেয়।
খরচ কমাতে বাধ্য হয়ে সরকার কৃচ্ছ সাধন নীতি বেছে নেয়। সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট ছাড়াও উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন কমিয়ে দেয়। চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রেডভিত্তিক ভাগ করে বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে জোর দেয়া হয়। সরকারের এসব পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক প্রভাব কম থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা বৃদ্ধি পায়। এতে বিদায়ী (২০২২-২৩) অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) অর্থনীতির প্রায় সব সূচক বেশ খারাপ অবস্থায় ছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের (জানুয়ারি-মার্চ) প্রান্তিকভিত্তিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে কম। আমদানি প্রবৃদ্ধি ওই সময় ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি কার্গো হ্যান্ডলিংয়েও ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। আর আমদানি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও, তা ছিল খুবই সামান্য। সরকারের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও এ সময় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। আবার মূল্যস্ফীতি ছিল সবচেয়ে বেশি।
গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারের রাজস্ব আদায়ের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তা বেড়ে যায়। ওই সময় রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর তৃতীয় প্রান্তিকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই তিন প্রান্তিকে এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬৭ হাজর ১০০ কোটি, ৭৮ হাজার ৩০০ কোটি ও ৫০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে রাজস্ব আদায়ে ছয় দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও, তৃতীয় প্রান্তিকে তা তিন দশমিক ৬ শতাংশে নেমে যায়। একইভাবে এনবিআর রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় পরের দুই প্রান্তিকে কমেছে।
রাজস্ব আদায় কম হওয়ার প্রভাব দেখা গেছে সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রেও। প্রথম প্রান্তিকে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে আয় বাড়ায় ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ সাত হাজার কোটি টাকায়। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে আয় কমায় ব্যয়ও কমে যায়। ওই সময় সরকার ব্যয় করে ৬২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের ৯ মাসের মধ্যে তৃতীয় প্রান্তিকে সরকার চলতি তথা অনুন্নয়ন ব্যয় সবচেয়ে বেশি কাটছাঁট করেছে। প্রথম প্রান্তিকে সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয় ছিল ৭১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৬২ হাজার ২০০ কোটি ও তৃতীয় প্রান্তিকে ২৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বিদায়ী অর্থবছর সরকারের বাজেট ঘাটতিও তৃতীয় প্রান্তিকে ছিল সর্বোচ্চ। প্রথম প্রান্তিকে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২১ হাজার কোটি টাকা। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে তা এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যায়। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বাজেট ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর ঘাটতি বাড়ায় তৃতীয় প্রান্তিকে সরকারের ব্যাংকঋণও বেড়েছে অনেক বেশি। ওই সময় সরকার ব্যাংকঋণ নেয় ২৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫০০ কোটি ও প্রথম প্রান্তিকে আট হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেটের বাকিটা বিদেশি ঋণে মেটানো হয়েছে।
গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, দ্বিতীয় প্রান্তিকে রপ্তানি হয় ১৪ বিলিয়ন ডলার ও তৃতীয় প্রান্তিকে ১৩ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। পরিমাণের দিক থেকে খুব একটা না কমলেও বছরভিত্তিক প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রতি প্রান্তিকেই। প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। তৃতীয় প্রান্তিকে তা দুই শতাংশে নেমে যায়।
এর মূল কারণ, বাংলাদেশের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল পাঁচ দশমিক ১৩ শতাংশ। পরের প্রান্তিকে তা ছিল দুই দশমিক ২১ শতাংশ ঋণাত্মক আর তৃতীয় প্রান্তিকে প্রায় ১৬ শতাংশ ঋণাত্মক। আর ইউরোপের দেশগুলোয় প্রথম প্রান্তিকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কিছুটা বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ৮১ শতাংশ।
এদিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আমদানির পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার, দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে হয় ১৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার ও তৃতীয় প্রান্তিকে ১৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। পরিমাণের দিক থেকে কমার পাশাপাশি দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা ১০ শতাংশ ঋণাত্মক হয়। আর তৃতীয় প্রান্তিকে তা প্রায় ২৫ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে।
এলসি খোলায় গত বছরের শুরু থেকেই সরকার কড়াকড়ি আরোপ করে। বিশেষত বিলাস দ্রব্যের আমদানি কঠোর করা হয়। তবে ডলার সংকট ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রায় সব ধরনের এলসি খোলাই গত অর্থবছর কমেছে। এর মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও ভোগ্যপণ্যের এলসিও ছিল। আবার এলসি সেটেলমেন্টও কমেছে এ সময়।
প্রতিবেদনের দেখা যায়, গত অর্থবছর প্রথম প্রান্তিকে এলসি খোলায় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশ, দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৩৬ দশমিক ১৫ শতাংশ ঋণাত্মক ও তৃতীয় প্রান্তিকে ২৭ দশমিক ৪২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। আর প্রথম প্রান্তিকে এলসি সেলেটমেন্টে ৩০ দশমিক ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। তবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ ঋণাত্মক ও তৃতীয় প্রান্তিকে ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়