পুরান ঢাকার টমটম ঐতিহ্য নাকি অমানবিকতা!

শেখ শাহরিয়ার হোসেন ক্যাম্পাস প্রতিনিধি, জবি সংবাদ দাতা (ঢাকা)
পুরান ঢাকার টমটম ঐতিহ্য নাকি অমানবিকতা!

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নগরীর নাম আসলেই যে নামটি সবার প্রথমে মাথায় আসবে সেটা হলো ঢাকা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ ঢাকা আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে আসছে বহু বছর ধরে। শুধু দেশি পর্যটকই নয় অনেক বিদেশি হাজারো পর্যটক প্রতিদিন আসে পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য দেখতে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো এখানকার ঘোড়ার গাড়ি। আগে যখন যন্ত্রচালিত বাহন ছিল না, তখন মানুষ পশুচালিত গাড়িতে করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতো। আর এই পশুচালিত বাহনের মধ্যে টিকা গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি শুধুমাত্র জমিদার ও নবাবের বাহন ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটির দেখা শুধুমাত্র পুরান ঢাকাতেই মিলবে।

রূপকথার গল্পে যেমন রাজপুত্র তার সঙ্গিনীকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তেপান্তর পাড়ি দিতো, নবাব কিংবা রাজবংশের লোক ছাড়া সাধারণ মানুষের যে গাড়িতে চড়া একপ্রকার স্বপ্নের পর্যায়ে ছিলো, আজকের এই যন্ত্রের যুগে আপনি চাইলে খুব সহজেই সেই ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে পারবেন।

রাজা-বাদশা, জমিদারদের আভিজাত্য প্রকাশ করার মাধ্যম ছিল ঘোড়ার গাড়ি। সেই আভিজাত্য এখন আর নেই, মুছে গেছে অনেক আগেই। এখন লড়াই অস্তিত্বের। এক সময় পুরান ঢাকার পরিচয় ছিল ঘোড়ার গাড়ির শহর হিসেবে।

যাত্রী পরিবহন ছাড়াও টমটম পূজা-পার্বন বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা ও সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহৃত হয়। এসব কাজে টমটমের মালিক একটু বেশি টাকা দাবি করে থাকেন। এসব সময় টমটমকে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। তাছাড়া কোচোয়ান বা গাড়িচালক ও হেলপারের জন্যও সেসব অনুষ্ঠানে রয়েছে বিশেষ পোশাক। তাছাড়া বিয়ে, গায়েহলুদের অনুষ্ঠানগুলোতেও ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার দেখা যায়। পুরান ঢাকায় বিয়েতে আজও ঘোড়ার গাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রতিদিন এই গাড়ি পুরান ঢাকার সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা দিয়ে উপভোগ করতে পারবেন রাজকীয় এক অনুভূতি। যেখানে মানুষ বাস, রিকশা, সিএনজি তে করে যাতায়াত করছে, আর ঘোড়ার গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে একটু ভিন্ন। তবে এই টমটম গাড়ির সাথে আভিজাত্য ছাড়াও জড়িয়ে আছে কিছু অমানবিক নির্যাতনের কথা। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই টমটম গাড়ির পেছনে যুগ যুগ ধরে যে অমানবিক নিষ্ঠুরতা বয়ে চলেছে, বাংলার ঐতিহ্যে তা কারও দৃষ্টিতে অমানবিক বলে মনে হয় না। টমটম গাড়ির ঘোড়া যখন গড়ে চার-পাঁচশ কেজি ওজনের যাত্রী নিয়ে পিচঢালা পথে দৌড়ায়, তখন তার পায়ের শক্ত খুর ক্ষয়ে পায়ের নরম মাংস বের হয়ে যায়। এই নরম মাংসের ওপর ভর করে পিচঢালা পথে দৌড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে ঘোড়ার পায়ের খুরের স্টিলের খাঁজ পরানো হয়, যাতে পায়ের খুর ক্ষয় না হয়। আর এই পায়ের মাংসে পেরেক দিয়ে যখন স্টিলের খাঁজ লাগানো হয়, সে পেরেক তখন নরম মাংসেই গিয়ে লাগে। ফলে অসম্ভব যন্ত্রণা এবং ব্যথা নিয়ে ঘোড়াকে পিচের ওপর দৌড়াতে হয়। সাধারণত একটি স্টিলের খাঁজ এক দিনের বেশি টেকসই হয় না। টমটমের মালিকও এটা নিয়মিত পরিবর্তন করে না। যখন অসহায় ঘোড়া যন্ত্রনাক্লিষ্ট পা নিয়ে কাতরায় কিংবা পা শক্ত পিচে ফেলে দৌড়াতে পারে না, তখন ঘোড়ার পিঠে পড়তে থাকে কোচোয়ানের শপাং-শপাং চাবুক।

আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সভ্যতায় এসে অমানবিক এই নিষ্ঠুরতা আমরা উপভোগ করছি শুধুমাত্র নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য। রিকশা, বাস, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার থাকতে এখনও এই অমানবিক ঘোড়ায় টানা গাড়ি নগরের সড়কে মানুষের যানবাহন হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে যা অমানবিকতার চরম শিখরে নিয়ে গিয়েছে আমাদের৷ তাই ঐতিহ্যের নামে অমানবিকতা বন্ধ এখন সময়ের দাবি।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পুরান ঢাকার টমটম ঐতিহ্য নাকি অমানবিকতা!

পুরান ঢাকার টমটম ঐতিহ্য নাকি অমানবিকতা!

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নগরীর নাম আসলেই যে নামটি সবার প্রথমে মাথায় আসবে সেটা হলো ঢাকা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ ঢাকা আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে আসছে বহু বছর ধরে। শুধু দেশি পর্যটকই নয় অনেক বিদেশি হাজারো পর্যটক প্রতিদিন আসে পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য দেখতে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো এখানকার ঘোড়ার গাড়ি। আগে যখন যন্ত্রচালিত বাহন ছিল না, তখন মানুষ পশুচালিত গাড়িতে করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতো। আর এই পশুচালিত বাহনের মধ্যে টিকা গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি শুধুমাত্র জমিদার ও নবাবের বাহন ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটির দেখা শুধুমাত্র পুরান ঢাকাতেই মিলবে।

রূপকথার গল্পে যেমন রাজপুত্র তার সঙ্গিনীকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তেপান্তর পাড়ি দিতো, নবাব কিংবা রাজবংশের লোক ছাড়া সাধারণ মানুষের যে গাড়িতে চড়া একপ্রকার স্বপ্নের পর্যায়ে ছিলো, আজকের এই যন্ত্রের যুগে আপনি চাইলে খুব সহজেই সেই ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে পারবেন।

রাজা-বাদশা, জমিদারদের আভিজাত্য প্রকাশ করার মাধ্যম ছিল ঘোড়ার গাড়ি। সেই আভিজাত্য এখন আর নেই, মুছে গেছে অনেক আগেই। এখন লড়াই অস্তিত্বের। এক সময় পুরান ঢাকার পরিচয় ছিল ঘোড়ার গাড়ির শহর হিসেবে।

যাত্রী পরিবহন ছাড়াও টমটম পূজা-পার্বন বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা ও সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহৃত হয়। এসব কাজে টমটমের মালিক একটু বেশি টাকা দাবি করে থাকেন। এসব সময় টমটমকে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। তাছাড়া কোচোয়ান বা গাড়িচালক ও হেলপারের জন্যও সেসব অনুষ্ঠানে রয়েছে বিশেষ পোশাক। তাছাড়া বিয়ে, গায়েহলুদের অনুষ্ঠানগুলোতেও ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার দেখা যায়। পুরান ঢাকায় বিয়েতে আজও ঘোড়ার গাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রতিদিন এই গাড়ি পুরান ঢাকার সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা দিয়ে উপভোগ করতে পারবেন রাজকীয় এক অনুভূতি। যেখানে মানুষ বাস, রিকশা, সিএনজি তে করে যাতায়াত করছে, আর ঘোড়ার গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে একটু ভিন্ন। তবে এই টমটম গাড়ির সাথে আভিজাত্য ছাড়াও জড়িয়ে আছে কিছু অমানবিক নির্যাতনের কথা। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই টমটম গাড়ির পেছনে যুগ যুগ ধরে যে অমানবিক নিষ্ঠুরতা বয়ে চলেছে, বাংলার ঐতিহ্যে তা কারও দৃষ্টিতে অমানবিক বলে মনে হয় না। টমটম গাড়ির ঘোড়া যখন গড়ে চার-পাঁচশ কেজি ওজনের যাত্রী নিয়ে পিচঢালা পথে দৌড়ায়, তখন তার পায়ের শক্ত খুর ক্ষয়ে পায়ের নরম মাংস বের হয়ে যায়। এই নরম মাংসের ওপর ভর করে পিচঢালা পথে দৌড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে ঘোড়ার পায়ের খুরের স্টিলের খাঁজ পরানো হয়, যাতে পায়ের খুর ক্ষয় না হয়। আর এই পায়ের মাংসে পেরেক দিয়ে যখন স্টিলের খাঁজ লাগানো হয়, সে পেরেক তখন নরম মাংসেই গিয়ে লাগে। ফলে অসম্ভব যন্ত্রণা এবং ব্যথা নিয়ে ঘোড়াকে পিচের ওপর দৌড়াতে হয়। সাধারণত একটি স্টিলের খাঁজ এক দিনের বেশি টেকসই হয় না। টমটমের মালিকও এটা নিয়মিত পরিবর্তন করে না। যখন অসহায় ঘোড়া যন্ত্রনাক্লিষ্ট পা নিয়ে কাতরায় কিংবা পা শক্ত পিচে ফেলে দৌড়াতে পারে না, তখন ঘোড়ার পিঠে পড়তে থাকে কোচোয়ানের শপাং-শপাং চাবুক।

আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সভ্যতায় এসে অমানবিক এই নিষ্ঠুরতা আমরা উপভোগ করছি শুধুমাত্র নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য। রিকশা, বাস, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার থাকতে এখনও এই অমানবিক ঘোড়ায় টানা গাড়ি নগরের সড়কে মানুষের যানবাহন হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে যা অমানবিকতার চরম শিখরে নিয়ে গিয়েছে আমাদের৷ তাই ঐতিহ্যের নামে অমানবিকতা বন্ধ এখন সময়ের দাবি।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Download
ঠিকানা: পূর্ব কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ নিবন্ধনের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত