মোঃ ইসমাঈল হোসেন সোহাগ। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান সোহাগ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। দিনের বেশির ভাগ সময়ই এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্ত পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাক্ষণই নিজের পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে দুঃচিন্তা থাকতে হয় তাকে।
প্রতারণার মাধ্যমে ও ভূমিহীন মিথ্যা পরিচয় দিয়ে প্রতিবেশী আবু মিয়া তার স্ত্রী, মেয়ে এবং মেয়ের জামাইসহ ৮জনের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছে সোহাগের পরিবারের বসতবাড়ি ও দখলে থাকা জমি। বন্ধ করে দিয়েছে বাড়িতে ঢোকার সব পথ।
এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানোর চিন্তায় বেহাল তার পরিবার। সোহাগের পরিবার লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরলরেঞ্চ ইউনিয়নের উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামের বাসিন্দা।
দাদা আলী আহমদ পাটওয়ারীর সাথে ১০ সদস্যের যৌথ পরিবারে তাদের বসবাস। পুরো পরিবার কৃষি শ্রমজীবি ভূমিহীন এবং অত্যন্ত দরিদ্র। প্রতিবেশী আবু আবুল কালাম ওরফে আবু মিয়ার প্রতারণায় তাদের পরিবারে এখন চিন্তার ভাঁজ। চলাচলের পথঘাট হারিয়ে এক নির্মম মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা।
সরেজমিনে গিয়ে এসব জানা গেছে।
ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামের বিলাত আলীর বাড়ির বাসিন্দা আলী আহমদ পাটওয়ারী (৭০) একজন ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক এবং নিরক্ষর ব্যক্তি।
বিলাত আলীর বাড়িতে তার কোন ভূমি না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে ছিলেন তিনি। কিন্ত গ্রামের উত্তর চর লরেঞ্চ মৌজায় বেশ কিছু সরকারি খাস জমি পড়েছিল।
১৯৮১-৮২ সালের দিকে (৪২ বছর আগে) গ্রামের অসংখ্য খাস জমিরে মধ্যে ৬৯ শতক সরকারি খাস জমিতে গিয়ে বসতি গড়েন আলী আহম্মদ পাটোয়ারী৷ নিজের মালিকানাধীন ভূমি না থাকায় ছেলে মেয়ে এবং পারিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে সরকারি ভূমিতে বসবাস ও চাষাবাদ শুরু করেন।
আলী আহমদ পাটওয়ারী জানান, বসতবাড়ি গড়ার
কয়েক বছর পর তার দখলকৃত খাস জমিটি বন্দোবস্ত নেওয়ার জন্য তৎকালীন স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করেন তিনি। জমি বন্দোবস্তের খোঁজ নিতে গিয়ে তার সাথে ভূমি অফিসে দেখা হয় প্রতিবেশী জয়নাল মেম্বার বাড়ির বাসিন্দা আবুল কালাম ওরফে আবু মিয়ার( বর্তমানে মৃত) সাথে। ঘটনাটি শুনে আবু মিয়া আমার দখলে থাকা ৬৯ শতক খাস জমি বন্দোবস্ত পাইয়ে দিতে আমাকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। বিনিময়ে অফিস খরচ বাবত ১ লাখ টাকা দাবি করেন। এরপর আমি সরল বিশ্বাসে রাজি হয়ে
দিয়ে আমাকে ভূমি অফিস থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে।
সেদিনের পর এলাকায় ফিরে প্রতিবেশী আবু মিয়া আমার দখলকৃত খাস জমি ও বসতবাড়ির সাথে থাকা আরো কিছু খাস জমি তার দখলে নেন। তবে পূর্ব থেকে ভূমি মালিক থাকা সত্ত্বেও খাস জমি দখল করেন তিনি।
এর মাঝে আমার দখলকৃত জমি বন্দোবস্ত পেতে আমি অফিস খরচ হিসেবে আমি তাকে ৭০ হাজার টাকাও দিয়েছি।
আলী আহমদ পাটওয়ারী জানান, কিছুদিন পর আবু কালাম (আবু মিয়া) আমার নামে জমি বন্দোবস্ত হয়েছে বলে আমাকে মৌখিক জানায়। আমি লেখাপড়া জানি না। তার কাছ থেকে জমির কাগজপত্র দেখতে চাইলে নানা তালবাহানা করে। আবু মিয়া বলেছিল আমার নামে বন্দোবস্ত জমির দলিল ও খতিয়ান তার নিকট হেফাজতে রয়েছে। তার কথা শুনে আমি নিশ্চত ছিলাম।
গত ৬/৭ বছর আগে সে হজে যাওয়ার পূর্বে আমাকে বলে গিয়েছিল আমার জমির দলিল তার নিকট রয়েছে। হজের থেকে ফিরে এসে আমাকে দলিল দিয়ে দিবে। আমি তার কথায় সব কিছু সরল বিশ্বাস করি।
আলী আহমেদ পাটোয়ারী বলেন, গত কয়েক বছর আগে প্রতিবেশীদের মাধ্যমে জানতে পারি আমি যে ভূমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করছি, সেটি আবু মিয়া তার স্ত্রী, তার ৩ মেয়ে এবং ৩ জামাইসহ ৮ জনের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছে। এতে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে তার মাথায়। কত বড় প্রতারণা করে আবু মিয়া! এখন যাবার কোন জায়গা না থাকায় বৃদ্ধ আলী আহমদ পরিবারের আরও ১০ জন সদস্যকে নিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন৷ আলী আহমদের বড় ছেলে শাহ আলম একজন শ্রমিক। শাহ আলমের বড় ছেলে সোহাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছে আবু।
ওই জমিতে আলী আহম্মদ পাটোয়ারীর ঘর ছাড়াও ছেলে শাহ আলমেরও বসতঘর রয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই বসবাস করছেন সেখানে।
২০২২ সালের দিকে আবু মিয়া মারা যান। তখন তার ওয়ারিশদের মাধ্যমে জানতে পারি ২০১৩-১৪ সালের দিকে আবু মিয়া আমার বাড়ির জমি ও চাষাবাদের জমি আমার নামে বন্দোবস্ত না নিয়ে তার পরিবারের ৮ সদস্যের নামে বন্দোবস্ত নেন। যার খরচ নিয়েছে আমার থেকে ৮০ হাজার টাকা। বিষয়টি এতো বছর গোপন রেখেছিলেন। বন্দোবস্ত পাওয়া তার পরিবারের ৮ জন সদস্য হলেন, আবুল কালাম নিজে, তার স্ত্রী শাহিনুর বেগম, মেয়ে কামরুন নাহার মুন্নি, সামছুন নাহার সুমি, নুর নাহার লিপি ও তার তিন মেয়ে জামাতা আবুল হাসনাত খোকন, আবু বাশার এবং মো. ইসমাইল।
আবু মিয়া একই সময় এবং একই মৌজায় তার পরিবারের ৮ সদস্যের নামে চারটি পৃথক নথিতে আমার জমিসহ ১৯৫ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত নেয়।
ঘটনাটি জানাজানি হলে, ২০২২ সালে আমিসহ আমার পরিবারের সদস্যরা আবু মিয়ার জানাযায় উপস্থিত হয়ে শতশত গ্রামবাসীর মাঝে বিচার জানাই। গ্রামবাসীদের উপস্থিতিতে তার মেয়ের জামাইরা কথা দিয়েছিল তাদের নামে বন্দোবস্ত নেওয়া আমাদের বসতবাড়িসহ আমার জমি আমাকে ফেরত দেবে।
কিন্ত লাশ দাফনের পর থেকেই আলী আহমদ ও পরিবারের লোকজনকে উঠিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে আবুল কালামের ওয়ারিশরা৷ এখন তারা উল্টো আমাদের নামে বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাদেরকে বাস্তুচ্যুত করার পায়তারা করছে। আমরা এখন কোথায় যাবো ?
স্থানীয়রা জানায়, যাদের নামে বন্দোবস্ত নেওয়া হয়েছে, তাদেরকে ভূমিহীন দেখানো হয়েছে। কিন্তু এদের অনেকেই আগে থেকেই ভূমির মালিক ছিল।
আলী আহমেদ বলেন, আমি এখন আমার ছেলে এবং নাতি-নাতনীদের নিয়ে কোথায় যাব?
আলী আহমেদের নাতি.. বলেন, তথ্য গোপন করে আমার দাদাকে ঠকিয়ে প্রতারণা করে আবুল কালাম তার তার তার পরিবারের সদস্যদের নামে নথি বন্দোবস্ত নিয়েছে। তারা ভূমিহীন এবং জমির দখলদার দেখিয়ে এ নথি সৃজন করে। যা বন্দোবস্ত আইনে বৈধ নয়। আমরা বন্দোবস্ত বাতিলের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত দিয়েছি। স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমিকর্মকর্তা একাধিকবার এসে তদন্তও করে গেছেন।
আলী আহমদের ছেলে শাহ আলম বলেন, আবুল কালামের মৃত্যুর পর এলাকাবাসীর সামনে তার ওয়াশিরা আমাদের এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও এখন তালবাহানা করছে। আমাদেরকে দখলচ্যুত করার পাঁয়তারা করছে। আমাদের বাড়িতে ঢোকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যের জমির উপর দিয়ে আমরা হাঁটতেছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরার মানবেতর জীবনযাপন করতেছি।
স্থানীয় লোকজন জানায়, আবুল কালাম যে জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে, ওই জমিতে প্রায় ৪৫ বছর আগ থেকেই আলী আহমদের বসতি ও তার দখলে ছিল। কিন্তু আবুল কালাম ১৫-১৬ বছর আগে ওই জমির পাশে এসে বসতি তুলেছে। এখন শুনছি আলী আহমদের দখলে থাকা জমিও আবুল কালাম বন্দোবস্ত নিয়েছে।
তোরাবগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী শাহ আলম বেপারী বলেন, আলী আহমদ এবং আবুল কালামের জমির বিষয়টা আমি পূর্ব থেকে জানি। আবুল কালাম আলী আহমদের নামে জমে বন্দোবস্ত পাইয়ে দিবে বলে তার কাছ থেকে তখন ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। আমার হাতের উপর দিয়ে টাকা লেনদেন হয়েছে।
আবুল কালামের মেয়ের জামাই ইসমাইল হোসেন বলেন, ’জমিটি আমার শ্বশুরের। তিনি আমাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছেন। আলী আহম্মদকে মানবিক দৃষ্টিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি অন্যত্র যাচ্ছেন না। উল্টো আমাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করছেন। তাদের কোনো জমি নেই।’
চরলরেন্স ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কমকর্তা জাফর আকবর হোসাইন বলেন, ’আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। ঘটনাটি আমার জানা নেই। শুনেছি আমার আগের কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করেছেন।’ তবে বিষয়টি নিয়ে পরিবারটিকে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, ’ঘটনাটি আমার জানা আছে। আমি সোহাগদের এসিল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলাম। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হবে।’