জাল দলিল: ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রফিক

স্টাফ রিপোর্টার এজেড নিউজ বিডি, ঢাকা
জাল দলিল: ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রফিক
রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত

রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে কাউসার আহমেদ অপু নিজেদের জমি বিক্রি করেন। পরে বিক্রি করা জমি নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও ক্রয়-বিক্রয় করে তৈরি করেন জাল দলিল। সেই জাল দলিলের জমি আবার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এওয়াজ বদল করেন। এওয়াজ বদলে পাওয়া সেসব জমি ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় বন্ধক রেখে নেন ঋণ।

এভাবে জালিয়াতি করে রফিকুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা একই জমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি ও তিনটি ব্যাংকে বন্ধক রেখে প্রায় ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনুসন্ধানে রফিকুল ইসলামের জমি ক্রয় বিক্রয় ও ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতির এসব তথ্য উঠে এসেছে।

তিনটি ব্যাংক থেকে রফিকুলের জালিয়াতি করে নেওয়া টাকার পরিমাণ ৯৪৫ কোটি। এরমধ্যে ৪৭৫ কোটি নিয়েছেন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে, যা সুদসহ এখন দাঁড়িয়েছে ৭২৫ কোটি টাকায়।

ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২৭০ কোটি, সুদ আসলে যা এখন বেড়েছে। এ ছাড়া, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২০০ কোটি টাকা। এ ব্যাংকেরও সুদ আসলে পাওনা বেড়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পাওনা সুদ-আসলসহ হিসাব করলে রফিকুলের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকারও বেশি।

২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনটি ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিলেও মটগেজ হিসাবে রাখা হয়েছে একই জমি। সেই জমিগুলোর অধিকাংশই ঋণ নেওয়ার আগে বা পরে বিক্রি করে সটকে পড়েছেন রফিকুল। অন্যদিকে জমি ব্যাংকে বন্ধক রাখলে সে তথ্য গোপন করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। তিনি এমন প্রতারণা করে ৪২৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। রফিকুলের এমন প্রতারণা আর জালিয়াতির খপ্পরে পড়ে ঋণ দেওয়া টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চতায় পড়েছে ব্যাংকগুলো।

অন্যদিকে সাধারণ মানুষ জমিগুলো কিনলেও জমির বিপরীতে নেওয়া ঋণ, জাল দলিল ও দখল নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রফিকুল ইসলামের এমন জালিয়াতিতে ব্যাংক কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারেন। তা-না-হলে বিক্রি করা জমি দেখিয়ে কিভাবে ঋণ নেন। আর ঋণ নেওয়ার পর বন্ধকী জমি কিভাবে বিক্রি করেন। কারণ ব্যাংক তো মটগেজের জমি সরেজমিনে দেখে। জমির মূল্য নির্ধারণ সরেজমিনে কিভাবে করেছে? জমির মালিকানা যাচাইয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে খবর নেওয়ার কথা। রফিকুল ইসলামকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কি এসব নিয়ম মানেনি ব্যাংক?

বিশেষজ্ঞরা আরো মনে করেন, রফিকুল ইসলাম জমি বিক্রি করার পর সে জমি আবার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেনাবেচা দেখিয়ে যদি জাল দলিল বানান ও সে দলিলে উল্লেখ করা জমি অন্যের সঙ্গে এওয়াজ দলিলে বদল করে জমি নেন, সেটির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। কারণ তিনি যে জমি অন্যের সঙ্গে বদল করে নিচ্ছেন, সে জমিটিই তো তার না। একইভাবে ব্যাংক যদি বিক্রি করা জমি বন্ধক রাখে সেখানেও জটিলতা আছে। কারণ কার জমি বন্ধক রেখে কাকে ঋণ দেওয়া হলো? আবার কেউ যদি ব্যাংকে বন্ধক রাখা জমি কেনেন তাহলে তিনিও বিপদে পড়েছেন।

৩ ব্যাংকের সঙ্গে যেভাবে প্রতারণা
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, রফিকুল ইসলাম ৫ দফায় রংধনু বিল্ডার্স (প্রাইভেট) লিমিটেড ও মেসার্স মেহেদী মার্টের নামে এসআইবিএল থেকে ৪৭৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। এরমধ্যে ২০১৭ সালে এক দফায় নেন ৬০ কোটি টাকা। একই বছরের ৩০ আগষ্ট নেন ৮৫ কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালের ১৮ মে নেন ২১৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ১৫ জুলাই ৩০ কোটি এবং ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নেন ৮৫ কোটি টাকা।

রফিকুল ইসলাম ঋণ পরিশোধে অনিয়ম করায় বর্তমানে তাঁর কাছে সুদ-আসলে ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২৫ কোটি টাকা। রফিকুল ইসলাম চলতি ২০২৩ সালের ২২ জুলাই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় থেকে ২৭০ কোটি টাকা ঋণ নেন। নিজ নামের পাশাপাশি ছেলে মেহেদী হাসান দিপু, কাওসার আহমেদ অপু ও ছেলের স্ত্রী মালিহা হোসেনের নামেও এ ঋণ নেওয়া হয়। এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০২১ সালের ২৬ আগষ্ট ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল। কাওসার আহমেদ অপু ও রফিকুল ইসলামের নামে এ ঋণ নেওয়া হয়।

তিনটি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তির বিষয়ে অনুসন্ধানে উঠে আসে; রফিকুল ইসলাম জোয়ার সাহারা মৌজায় সিএস ও এসএ ৩২৫৯ নম্বর, আরএস ৯৫৯৫ এবং সিটি জরিপ ৩৮০০৭ নম্বর দাগে ১৬.৫০ শতাংশ ভূমি ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ৩৯৮৪ নম্বর বন্ধকী দলিলে এসআইবিএলের বসুন্ধরা শাখায় বন্ধক রাখেন। জমি বন্ধক দেওয়ার ৮ মাসের ব্যবধানে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ১১৯৩৪ নম্বর সাফ কবলা দলিল মূলে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের কাছে বিক্রি করে দেন।

এদিকে,এসআইবিএল থেকে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট আরো ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল। এ ঋণের বিপরীতে জোয়ার সাহারা মৌজার সিএস ও এসএ ৩২৮৫, ৩৩৫৯, ৩৩৭০ নম্বর, আরএস ১০০১৭, ১০০১৫, ১০০১৪ নম্বর, সিটি জরিপ-৪৮৮১৭, ৪৮৫৯৪, ৪৮৫৯৫ নম্বর দাগে ৩৮.০৮ শতাংশ জমির দলিল বন্ধক রাখেন তিনি। কিন্তু ২০২৩ সালের ২২ জুন এসআইবিএলের কাছে বন্ধক রাখা উল্লেখিত জমিগুলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছেও বন্ধক দেন। বন্ধকী দলিল নম্বর ৯৫৪৯।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রফিকুল ইসলাম জালিয়াতি করেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায়। এরমধ্যে তাঁর ছেলে কাওসার আহম্মেদ অপুর মালিকানায় দেখানো ০.৩৬৩০ একর জমি এসআইবিলের বন্ধকী দলিলে ৮৬৭৯-এ বন্ধক ছিল। এর সিএস ও এসএ দাগ ১৯৪৬ ও ১৯২১, আরএস দাগ ৭৫১৪ ও ৭৫১৬, সিটি জরিপ দাগ ১৯১২১ ও ১৯১৩৩। ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট জমিটি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে বন্ধক দেওয়া হয়। অথচ একটি প্রতিষ্ঠানকে জমির আম-মোক্তার বানিয়ে ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর মো. জাকির হোসেনের কাছে জমিটি বিক্রি করে দেন রফিকুল।

এ ছাড়াও রফিকুলে ছেলে কাওসার আহম্মেদ অপু নারায়ণগঞ্জের নাওড়া মৌজায় আরএস ১১৪৬, ৩২৭, ৫৬৩৫, ৪৭, ২৪৯ নম্বর দাগে ৬৬.৮০ শতাংশ জমি ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি তাসফিয়া আহসান জইতার কাছে বিক্রয় করেন। জইতার কাছে বিক্রি করা জমিটি ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ৭৪৭৪ নম্বর সাফ কবলা দলিল মূলে তাঁর বাবা রফিকুল ইসলামের কাছে পুনরায় বিক্রি করে জাল দলিল বানান। এরপর জইতার কাছে বিক্রি করা জমিটি রফিকুল ইসলামের মালিকানা দেখিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এওয়াজ বদল করে নতুন জমি নেন। জাল দলিলের পাওয়া এওয়াজ বদলের জমি এসআইবিএল ও ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল ইসলাম।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের ৮ মে ৪৭১৯ নম্বর বন্ধকী দলিলে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিক। এ ঋণের বিপরীতে ভাটারা মৌজার ১৯১৩৩, ১৯০২০, ১৯১৩২ নম্বর দাগে ৩৯.৬০ শতাংশ জমি বন্ধ রাখেন তিনি। জমিটি বন্ধক দেওয়ার ২ বছর বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে আম-মোক্তার নিয়োগ দেন।

শুধু ছেলে নয়, প্রতারণার কাজে ছেলেদের স্ত্রীকেও ব্যবহার করেছেন রফিকুল। রূপগঞ্জের নাওড়া মৌজার ১১৭৬১ নম্বর দলিলের ০.৬১ একর জমির মালিকানায় ছিলেন রফিকুল। ০.৬১ একর জমির মধ্যে ২০১৬ সালের ৩ মার্চ মো. আকবর হোসেনের কাছে ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ০.১৫ একর বিক্রি করেন রফিক। বাদবাকি .৪৬ একর জমির মধ্যে ০.১৫ একর জমি ২০১৬ সালের ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তামরিন মুজিবের কাছে বিক্রি করেন। দলিলে দেখা যায়, তামরিন মুজিবও ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ওই জমি কিনেন। এছাড়া ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি ০.১৫ একর জমি কিনেন সাহানা আক্তার খানম। তিনটি পৃথক দলিলে ০.৪৫ একর জমির পর রফিকের মালিকানায় মাত্র ছিল ১৬ শতাংশ জমি। কিন্তু রফিক ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার ছেলের বউ মালিহা হোসেন ও হুমায়রা নুজহাতের কাছে পুনরায় ৬১ শতাংশ জমির পুরোটা বিক্রি দেখিয়ে জাল দলিল করেন। রূপগঞ্জের নাওড়া মৌজার ০.৬১ একর জমিটি ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওয়াজবদল দলিলে জোয়ার সাহারা মৌজার ০.৬৩৪ একর জমি পায়।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মালিহা হোসেন ও হুমায়রা নুজহাতের কাছে জমি বিক্রির কিছু দিন পর ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মালিহা তাঁর স্বামী মেহেদী হাসান দিপুর নামে ৩১.৭ শতাংশ ও হুমায়রা নুজহাত স্বামী কাওসার আহমেদ অপুর নামে ৩১.৭ শতাংশ সম্পত্তি হেবা দলিল করেন। ছেলের স্ত্রীরা জাল দলিলের জমিটি স্বামীর নামে অর্থাৎ রফিকুলের দুই ছেলেকে দেওয়ার পর দুজনের নামে ৬৩.৪ শতাংশ জমি দেখিয়ে প্রথমে ২০১৯ সালের ৮ মে এসআইবিএলে বন্ধক রাখা হয়। পরে একই জমি ২০২৩ সালের ২২ জুন ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখেন রফিক।

এছাড়া ভাটার মৌজার ঢাকা সিটি জরিপ ৩০০৮ এ ০.১৫৫৩ একর জমি ছিল রফিকুল ইসলামের। যা ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তামান্না সুলতানার কাছে বিক্রি করে দেন। দলিল নম্বর ২৮০৮। অথচ জমিটি বিক্রির ১৬ মাস পর ২০২৩ সালের ২২ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে ওই একই জমি বন্ধক দেন রফিকুল, তাঁর ছেলে মেহেদী হাসান দিপু, কাওছার আহমেদ অপু ও পুত্রবধু মালিহা হোসেন।

রফিকুল ইসলামের থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই ব্লকের ৫৫১, ৫৫২, ৫৫৬, ৫৫৭ ও ৫৫৮ প্লট কিনেন মালিক ইমরান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর আইনজীবী মলয় রায় কালের কন্ঠকে বলেন, ‘গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর আমরা জানতে পেরেছি রফিকুল ইসলাম আমাদের জমি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়েছে।’

মলয় রায় আরো বলেন, ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ব্যাংকে চিঠি দিয়েছি। জমির মালিক রফিক নন, সেটি আমরা জানিয়েছি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।’

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাল দলিল: ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রফিক

জাল দলিল: ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রফিক
রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত

রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে কাউসার আহমেদ অপু নিজেদের জমি বিক্রি করেন। পরে বিক্রি করা জমি নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও ক্রয়-বিক্রয় করে তৈরি করেন জাল দলিল। সেই জাল দলিলের জমি আবার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এওয়াজ বদল করেন। এওয়াজ বদলে পাওয়া সেসব জমি ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় বন্ধক রেখে নেন ঋণ।

এভাবে জালিয়াতি করে রফিকুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা একই জমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি ও তিনটি ব্যাংকে বন্ধক রেখে প্রায় ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনুসন্ধানে রফিকুল ইসলামের জমি ক্রয় বিক্রয় ও ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতির এসব তথ্য উঠে এসেছে।

তিনটি ব্যাংক থেকে রফিকুলের জালিয়াতি করে নেওয়া টাকার পরিমাণ ৯৪৫ কোটি। এরমধ্যে ৪৭৫ কোটি নিয়েছেন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে, যা সুদসহ এখন দাঁড়িয়েছে ৭২৫ কোটি টাকায়।

ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২৭০ কোটি, সুদ আসলে যা এখন বেড়েছে। এ ছাড়া, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২০০ কোটি টাকা। এ ব্যাংকেরও সুদ আসলে পাওনা বেড়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পাওনা সুদ-আসলসহ হিসাব করলে রফিকুলের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকারও বেশি।

২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনটি ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিলেও মটগেজ হিসাবে রাখা হয়েছে একই জমি। সেই জমিগুলোর অধিকাংশই ঋণ নেওয়ার আগে বা পরে বিক্রি করে সটকে পড়েছেন রফিকুল। অন্যদিকে জমি ব্যাংকে বন্ধক রাখলে সে তথ্য গোপন করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। তিনি এমন প্রতারণা করে ৪২৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। রফিকুলের এমন প্রতারণা আর জালিয়াতির খপ্পরে পড়ে ঋণ দেওয়া টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চতায় পড়েছে ব্যাংকগুলো।

অন্যদিকে সাধারণ মানুষ জমিগুলো কিনলেও জমির বিপরীতে নেওয়া ঋণ, জাল দলিল ও দখল নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রফিকুল ইসলামের এমন জালিয়াতিতে ব্যাংক কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারেন। তা-না-হলে বিক্রি করা জমি দেখিয়ে কিভাবে ঋণ নেন। আর ঋণ নেওয়ার পর বন্ধকী জমি কিভাবে বিক্রি করেন। কারণ ব্যাংক তো মটগেজের জমি সরেজমিনে দেখে। জমির মূল্য নির্ধারণ সরেজমিনে কিভাবে করেছে? জমির মালিকানা যাচাইয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে খবর নেওয়ার কথা। রফিকুল ইসলামকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কি এসব নিয়ম মানেনি ব্যাংক?

বিশেষজ্ঞরা আরো মনে করেন, রফিকুল ইসলাম জমি বিক্রি করার পর সে জমি আবার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেনাবেচা দেখিয়ে যদি জাল দলিল বানান ও সে দলিলে উল্লেখ করা জমি অন্যের সঙ্গে এওয়াজ দলিলে বদল করে জমি নেন, সেটির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। কারণ তিনি যে জমি অন্যের সঙ্গে বদল করে নিচ্ছেন, সে জমিটিই তো তার না। একইভাবে ব্যাংক যদি বিক্রি করা জমি বন্ধক রাখে সেখানেও জটিলতা আছে। কারণ কার জমি বন্ধক রেখে কাকে ঋণ দেওয়া হলো? আবার কেউ যদি ব্যাংকে বন্ধক রাখা জমি কেনেন তাহলে তিনিও বিপদে পড়েছেন।

৩ ব্যাংকের সঙ্গে যেভাবে প্রতারণা
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, রফিকুল ইসলাম ৫ দফায় রংধনু বিল্ডার্স (প্রাইভেট) লিমিটেড ও মেসার্স মেহেদী মার্টের নামে এসআইবিএল থেকে ৪৭৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। এরমধ্যে ২০১৭ সালে এক দফায় নেন ৬০ কোটি টাকা। একই বছরের ৩০ আগষ্ট নেন ৮৫ কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালের ১৮ মে নেন ২১৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ১৫ জুলাই ৩০ কোটি এবং ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নেন ৮৫ কোটি টাকা।

রফিকুল ইসলাম ঋণ পরিশোধে অনিয়ম করায় বর্তমানে তাঁর কাছে সুদ-আসলে ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২৫ কোটি টাকা। রফিকুল ইসলাম চলতি ২০২৩ সালের ২২ জুলাই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় থেকে ২৭০ কোটি টাকা ঋণ নেন। নিজ নামের পাশাপাশি ছেলে মেহেদী হাসান দিপু, কাওসার আহমেদ অপু ও ছেলের স্ত্রী মালিহা হোসেনের নামেও এ ঋণ নেওয়া হয়। এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০২১ সালের ২৬ আগষ্ট ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল। কাওসার আহমেদ অপু ও রফিকুল ইসলামের নামে এ ঋণ নেওয়া হয়।

তিনটি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তির বিষয়ে অনুসন্ধানে উঠে আসে; রফিকুল ইসলাম জোয়ার সাহারা মৌজায় সিএস ও এসএ ৩২৫৯ নম্বর, আরএস ৯৫৯৫ এবং সিটি জরিপ ৩৮০০৭ নম্বর দাগে ১৬.৫০ শতাংশ ভূমি ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ৩৯৮৪ নম্বর বন্ধকী দলিলে এসআইবিএলের বসুন্ধরা শাখায় বন্ধক রাখেন। জমি বন্ধক দেওয়ার ৮ মাসের ব্যবধানে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ১১৯৩৪ নম্বর সাফ কবলা দলিল মূলে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের কাছে বিক্রি করে দেন।

এদিকে,এসআইবিএল থেকে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট আরো ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল। এ ঋণের বিপরীতে জোয়ার সাহারা মৌজার সিএস ও এসএ ৩২৮৫, ৩৩৫৯, ৩৩৭০ নম্বর, আরএস ১০০১৭, ১০০১৫, ১০০১৪ নম্বর, সিটি জরিপ-৪৮৮১৭, ৪৮৫৯৪, ৪৮৫৯৫ নম্বর দাগে ৩৮.০৮ শতাংশ জমির দলিল বন্ধক রাখেন তিনি। কিন্তু ২০২৩ সালের ২২ জুন এসআইবিএলের কাছে বন্ধক রাখা উল্লেখিত জমিগুলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছেও বন্ধক দেন। বন্ধকী দলিল নম্বর ৯৫৪৯।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রফিকুল ইসলাম জালিয়াতি করেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায়। এরমধ্যে তাঁর ছেলে কাওসার আহম্মেদ অপুর মালিকানায় দেখানো ০.৩৬৩০ একর জমি এসআইবিলের বন্ধকী দলিলে ৮৬৭৯-এ বন্ধক ছিল। এর সিএস ও এসএ দাগ ১৯৪৬ ও ১৯২১, আরএস দাগ ৭৫১৪ ও ৭৫১৬, সিটি জরিপ দাগ ১৯১২১ ও ১৯১৩৩। ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট জমিটি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে বন্ধক দেওয়া হয়। অথচ একটি প্রতিষ্ঠানকে জমির আম-মোক্তার বানিয়ে ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর মো. জাকির হোসেনের কাছে জমিটি বিক্রি করে দেন রফিকুল।

এ ছাড়াও রফিকুলে ছেলে কাওসার আহম্মেদ অপু নারায়ণগঞ্জের নাওড়া মৌজায় আরএস ১১৪৬, ৩২৭, ৫৬৩৫, ৪৭, ২৪৯ নম্বর দাগে ৬৬.৮০ শতাংশ জমি ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি তাসফিয়া আহসান জইতার কাছে বিক্রয় করেন। জইতার কাছে বিক্রি করা জমিটি ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ৭৪৭৪ নম্বর সাফ কবলা দলিল মূলে তাঁর বাবা রফিকুল ইসলামের কাছে পুনরায় বিক্রি করে জাল দলিল বানান। এরপর জইতার কাছে বিক্রি করা জমিটি রফিকুল ইসলামের মালিকানা দেখিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এওয়াজ বদল করে নতুন জমি নেন। জাল দলিলের পাওয়া এওয়াজ বদলের জমি এসআইবিএল ও ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল ইসলাম।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের ৮ মে ৪৭১৯ নম্বর বন্ধকী দলিলে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিক। এ ঋণের বিপরীতে ভাটারা মৌজার ১৯১৩৩, ১৯০২০, ১৯১৩২ নম্বর দাগে ৩৯.৬০ শতাংশ জমি বন্ধ রাখেন তিনি। জমিটি বন্ধক দেওয়ার ২ বছর বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে আম-মোক্তার নিয়োগ দেন।

শুধু ছেলে নয়, প্রতারণার কাজে ছেলেদের স্ত্রীকেও ব্যবহার করেছেন রফিকুল। রূপগঞ্জের নাওড়া মৌজার ১১৭৬১ নম্বর দলিলের ০.৬১ একর জমির মালিকানায় ছিলেন রফিকুল। ০.৬১ একর জমির মধ্যে ২০১৬ সালের ৩ মার্চ মো. আকবর হোসেনের কাছে ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ০.১৫ একর বিক্রি করেন রফিক। বাদবাকি .৪৬ একর জমির মধ্যে ০.১৫ একর জমি ২০১৬ সালের ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তামরিন মুজিবের কাছে বিক্রি করেন। দলিলে দেখা যায়, তামরিন মুজিবও ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ওই জমি কিনেন। এছাড়া ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি ০.১৫ একর জমি কিনেন সাহানা আক্তার খানম। তিনটি পৃথক দলিলে ০.৪৫ একর জমির পর রফিকের মালিকানায় মাত্র ছিল ১৬ শতাংশ জমি। কিন্তু রফিক ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার ছেলের বউ মালিহা হোসেন ও হুমায়রা নুজহাতের কাছে পুনরায় ৬১ শতাংশ জমির পুরোটা বিক্রি দেখিয়ে জাল দলিল করেন। রূপগঞ্জের নাওড়া মৌজার ০.৬১ একর জমিটি ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওয়াজবদল দলিলে জোয়ার সাহারা মৌজার ০.৬৩৪ একর জমি পায়।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মালিহা হোসেন ও হুমায়রা নুজহাতের কাছে জমি বিক্রির কিছু দিন পর ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মালিহা তাঁর স্বামী মেহেদী হাসান দিপুর নামে ৩১.৭ শতাংশ ও হুমায়রা নুজহাত স্বামী কাওসার আহমেদ অপুর নামে ৩১.৭ শতাংশ সম্পত্তি হেবা দলিল করেন। ছেলের স্ত্রীরা জাল দলিলের জমিটি স্বামীর নামে অর্থাৎ রফিকুলের দুই ছেলেকে দেওয়ার পর দুজনের নামে ৬৩.৪ শতাংশ জমি দেখিয়ে প্রথমে ২০১৯ সালের ৮ মে এসআইবিএলে বন্ধক রাখা হয়। পরে একই জমি ২০২৩ সালের ২২ জুন ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখেন রফিক।

এছাড়া ভাটার মৌজার ঢাকা সিটি জরিপ ৩০০৮ এ ০.১৫৫৩ একর জমি ছিল রফিকুল ইসলামের। যা ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তামান্না সুলতানার কাছে বিক্রি করে দেন। দলিল নম্বর ২৮০৮। অথচ জমিটি বিক্রির ১৬ মাস পর ২০২৩ সালের ২২ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে ওই একই জমি বন্ধক দেন রফিকুল, তাঁর ছেলে মেহেদী হাসান দিপু, কাওছার আহমেদ অপু ও পুত্রবধু মালিহা হোসেন।

রফিকুল ইসলামের থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই ব্লকের ৫৫১, ৫৫২, ৫৫৬, ৫৫৭ ও ৫৫৮ প্লট কিনেন মালিক ইমরান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর আইনজীবী মলয় রায় কালের কন্ঠকে বলেন, ‘গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর আমরা জানতে পেরেছি রফিকুল ইসলাম আমাদের জমি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়েছে।’

মলয় রায় আরো বলেন, ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ব্যাংকে চিঠি দিয়েছি। জমির মালিক রফিক নন, সেটি আমরা জানিয়েছি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।’

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Download
ঠিকানা: পূর্ব কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ নিবন্ধনের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত