শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক এজেড নিউজ বিডি, ঢাকা
শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় একাধিক সংঘাতে জড়ানোর জন্য প্রায় প্রতিদিনিই শিরোনাম হচ্ছে ইসরায়েল। একের পর সশস্ত্র গোষ্ঠী ও দেশের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাই সবার মনে উঁকি দিচ্ছে নানা প্রশ্নে—অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেছেন কি দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু? একসঙ্গে একাধিক সংঘাতে জড়িয়ে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন তিনি? সর্বশেষ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসি।

প্রতিবেদনটি শুরু হয় এভাবে, দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষ করতে চললো লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান। এদিকে, এই অঞ্চলে ইসরায়েলের একটি (ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে) যুদ্ধ ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) রাতে বৈরুতে এবং এর পরদিন শুক্রবার দক্ষিণ লেবাননে দ্বিতীয় দিনের মতো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা করেছে ইসরায়েল। এ ঘটনার পরই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জোরালো হয়েছে।

এদিকে, সংঘাত শেষ করার ক্রমাগত আহ্বান সত্ত্বেও উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে নতুন করে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল। গত সপ্তাহে দেশটির ভূখণ্ডে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতিও নিয়েছে দেশটি। ফলে ইসরায়েলের মিত্ররাও দেশটিকে সংযমের আহ্বান জানাচ্ছে।

ওইসব চাপ ও আহ্বানে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো করে এগিয়ে চলেছে ইসরায়েল। দেশটির এই একগুঁয়েমির জন্য তিনি কারণ দায়ী: ৭ অক্টোবর, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং যুক্তরাষ্ট্র।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে দামেস্ক থেকে রাতের ফ্লাইটে বাগদাদ বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলেন ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানি। তিনি ইরানের বিপ্লবী গার্ডস কর্পসের একটি অভিজাত শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন।

কুদস নামের অর্থ জেরুজালেম। এই বাহিনীর প্রধান শত্রু ইসরায়েল। লক্ষ্য অর্জনে বাহিনীটি ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন ও অন্যান্য স্থানে প্রক্সি বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা, প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন, ও পরিচালনায় কাজ করছে।

তখন দেশটির প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পর সোলেইমানিকে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো। সেদিন সোলেইমানির গাড়িবহর বিমানবন্দর ছাড়ার পরপরই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।

ইসরায়েল তার চির-প্রতিপক্ষকে খুঁজে বের করতে যদিও তখন গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছিল, তবে হামলাকারী ড্রোনটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নয়, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

একটি ভাষণে সোলেইমানি হত্যার উল্লেখ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘আমি কখনও ভুলিনি নেতানিয়াহু আমাদের হতাশ করেছিলেন।’ পরে পৃথক একটি সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, কাসেম সোলাইমানির ওপর হামলার ঘটনায় ইসরায়েলের কাছ থেকে আরও সক্রিয় ভূমিকা আশা করেছিলেন তিনি। তার অভিযোগ, নেতানিয়াহু ‘শেষ আমেরিকান সেনা হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে লড়তে ইচ্ছুক।’

ট্রাম্পের এসব ঘটনা বিবরণ অবশ্য বিতর্কিত।

তবে সোলাইমানিকে হত্যার প্রশংসা করেছিলেন নেতানিয়াহু। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই হামলায় ইসরায়েল সরাসরি ভূমিকা পালন করলে দেশটিকে একটি বড় আকারের আক্রমণ শিকার হতে হতো। সেটা হয় ইরান থেকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে লেবাননে দেশটির প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো পক্ষ থেকে আসতো। তাই ইরানের সঙ্গে এতদিন ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত ছিল ইসরায়েল। তবে প্রতিটি পক্ষই এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটিকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখতে সচেতন ছিল। কেননা, পান থেকে চুন খসলেই এই অঞ্চলে যে কোনও বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত উস্কে দেওয়ার ভয় উভয়ের মধ্যেই ছিল।

এর মাত্র চার বছর পরই চলতি বছরের এপ্রিলে সেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুই দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক ভবনে বিমান হামলার নির্দেশ দেন। ওই হামলায় অন্যদের সঙ্গে দুই ইরানি জেনারেল নিহত হন।

এরপর জুলাইয়ে বৈরুতে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে হত্যা করার অনুমোদন দেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে, গত বছরের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস, যা ইসরায়েলের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী হামলা ছিল। দেশটির রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতারই প্রতিফলন ছিল এই হামলা।

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সমাপ্ত হয়েছিল। একবার আন্তর্জাতিক চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধবিরতির জন্য জোর দিতে বাধ্য হয়।

ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলার হিংস্রতা ও মাত্রা, ইসরায়েলি সমাজের ওপর এর প্রভাব ও নিরাপত্তা প্রশ্ন এটিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এই যুদ্ধ সাম্প্রতিক অন্যান্য সংঘাতের একেবারেই বিপরীত হতে চলেছে।

এদিকে, ইসরায়েলকে কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। আর সেগুলো ব্যবহার করে গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের হত্যা করে চলেছে ইসরায়েল। গাজায় অসংখ্য প্রাণহানি ও ফিলিস্তিনিদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ রাজনৈতিকভাবে মার্কিন প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। এই অঞ্চলে আমেরিকার সমালোচকদের ব্যাপক সমালোচনা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অনেক দিন ধরেই গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

এদিকে, এপ্রিলে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সেগুলো প্রতিহত করতে সক্ষম হয় তেল আবিব। এই ঘটনা ইসরায়েলের নিরাপত্তায় দেশটির বৃহত্তর মিত্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকাই স্পষ্ট করেছিল। যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ইসরায়েল।

গাজায় হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধের মধ্যেই, যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই চলতি গ্রীষ্মে হিজবুল্লাহর সঙ্গে আরেকটি সংঘাতে জড়ায় ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ২০ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন, মার্কিন চাপকে উপেক্ষা না করা গেলেও তা ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন, নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনও পদক্ষেপ নেবে না যা তাকে (নেতানিয়াহু) লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। (কেননা, তিনি বিশ্বাস করেন, যে কোনও ক্ষেত্রে আমেরিকার শত্রুদের সঙ্গেই লড়ছেন তিনি।)

সর্বশেষ সংঘাতের বিষয় এলে এটি ভাবা ভুল হবে যে, নেতানিয়াহু ইসরায়েলের রাজনৈতিক মূলধারার বাইরে কাজ করছেন। বরং তার ওপর হিজবুল্লাহ ও ইরানের বিরুদ্ধেও কঠোর হামলার চাপ রয়েছে।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স যখন লেবাননে একটি যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা উত্থাপন করেছ তখন নেতানিয়াহুর বিরোধীসহ দেশটির প্রধান বামপন্থি, এমনকি ডানপন্থি দলগুলোও প্রস্তাবিত ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির সমালোচনা করেছিল।

ইসরায়েল এখন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে এটি এ জন্য নয় যে, দেশটি আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করতে পারে, বরং ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল যে হুমকির প্রতি আর সহনশীল নয় সে জন্যও।

গত কয়েক বছর ধরে উত্তর ইসরায়েলের গ্যালিলে আক্রমণ করার লক্ষ্যের কথা প্রকাশ্যে বলে আসছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি জনগণ যেহেতু এখন বাড়িতে বন্দুকধারীদের অনুপ্রবেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছে, তখন সেই হুমকি আর সহ্য করা নয় বরং, সে ভয় অবশ্যই দূর করা উচিত।

ঝুঁকি নিয়ে ইসরায়েলের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। এই অঞ্চলে দীর্ঘকালের সামরিক রেড লাইনের রাখার ধারণাটিও এখন উড়ে গেছে। গত বছরে এমন বেশ কিছু কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে যা সম্প্রতি তেহরান, বৈরুত, তেল আবিব ও জেরুজালেমে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের বৃষ্টির মতো সর্বাত্মক সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তেহরানে অতিথি হিসেবে অবস্থানকালে হামাসের প্রধানকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এমনকি দেশটি হাসান নাসরাল্লাহসহ হিজবুল্লাহর পুরো নেতৃত্বকেও হত্যা করেছে। সিরিয়ায় কূটনৈতিক ভবনের ভিতরে সিনিয়র ইরানি কর্মকর্তাদেরও হত্যা করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি দেশটি।

তেল আবিবের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলাসহ ইসরায়েলি শহরগুলোতে ৯ হাজারেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন নিক্ষেপ করেছে হিজবুল্লাহ। ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের হুথিরাও থেমে নেই। মধ্য ইসরায়েলের শহরগুলোতে বড় ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছ গোষ্ঠীটি। যদিও এসব হামলার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রতিরোধ করেছে ইসরায়েল।

গত ছয় মাসে ইসরায়েলের ওপর একটি নয় বরং, দুটি হামলা চালিয়েছে ইরান। তখন ৫০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল দেশটি। এই হামলার জবাবের লেবাননে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?

শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় একাধিক সংঘাতে জড়ানোর জন্য প্রায় প্রতিদিনিই শিরোনাম হচ্ছে ইসরায়েল। একের পর সশস্ত্র গোষ্ঠী ও দেশের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাই সবার মনে উঁকি দিচ্ছে নানা প্রশ্নে—অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেছেন কি দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু? একসঙ্গে একাধিক সংঘাতে জড়িয়ে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন তিনি? সর্বশেষ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসি।

প্রতিবেদনটি শুরু হয় এভাবে, দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষ করতে চললো লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান। এদিকে, এই অঞ্চলে ইসরায়েলের একটি (ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে) যুদ্ধ ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) রাতে বৈরুতে এবং এর পরদিন শুক্রবার দক্ষিণ লেবাননে দ্বিতীয় দিনের মতো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা করেছে ইসরায়েল। এ ঘটনার পরই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জোরালো হয়েছে।

এদিকে, সংঘাত শেষ করার ক্রমাগত আহ্বান সত্ত্বেও উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে নতুন করে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল। গত সপ্তাহে দেশটির ভূখণ্ডে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতিও নিয়েছে দেশটি। ফলে ইসরায়েলের মিত্ররাও দেশটিকে সংযমের আহ্বান জানাচ্ছে।

ওইসব চাপ ও আহ্বানে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো করে এগিয়ে চলেছে ইসরায়েল। দেশটির এই একগুঁয়েমির জন্য তিনি কারণ দায়ী: ৭ অক্টোবর, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং যুক্তরাষ্ট্র।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে দামেস্ক থেকে রাতের ফ্লাইটে বাগদাদ বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলেন ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানি। তিনি ইরানের বিপ্লবী গার্ডস কর্পসের একটি অভিজাত শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন।

কুদস নামের অর্থ জেরুজালেম। এই বাহিনীর প্রধান শত্রু ইসরায়েল। লক্ষ্য অর্জনে বাহিনীটি ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন ও অন্যান্য স্থানে প্রক্সি বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা, প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন, ও পরিচালনায় কাজ করছে।

তখন দেশটির প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পর সোলেইমানিকে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো। সেদিন সোলেইমানির গাড়িবহর বিমানবন্দর ছাড়ার পরপরই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।

ইসরায়েল তার চির-প্রতিপক্ষকে খুঁজে বের করতে যদিও তখন গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছিল, তবে হামলাকারী ড্রোনটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নয়, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

একটি ভাষণে সোলেইমানি হত্যার উল্লেখ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘আমি কখনও ভুলিনি নেতানিয়াহু আমাদের হতাশ করেছিলেন।’ পরে পৃথক একটি সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, কাসেম সোলাইমানির ওপর হামলার ঘটনায় ইসরায়েলের কাছ থেকে আরও সক্রিয় ভূমিকা আশা করেছিলেন তিনি। তার অভিযোগ, নেতানিয়াহু ‘শেষ আমেরিকান সেনা হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে লড়তে ইচ্ছুক।’

ট্রাম্পের এসব ঘটনা বিবরণ অবশ্য বিতর্কিত।

তবে সোলাইমানিকে হত্যার প্রশংসা করেছিলেন নেতানিয়াহু। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই হামলায় ইসরায়েল সরাসরি ভূমিকা পালন করলে দেশটিকে একটি বড় আকারের আক্রমণ শিকার হতে হতো। সেটা হয় ইরান থেকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে লেবাননে দেশটির প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো পক্ষ থেকে আসতো। তাই ইরানের সঙ্গে এতদিন ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত ছিল ইসরায়েল। তবে প্রতিটি পক্ষই এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটিকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখতে সচেতন ছিল। কেননা, পান থেকে চুন খসলেই এই অঞ্চলে যে কোনও বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত উস্কে দেওয়ার ভয় উভয়ের মধ্যেই ছিল।

এর মাত্র চার বছর পরই চলতি বছরের এপ্রিলে সেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুই দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক ভবনে বিমান হামলার নির্দেশ দেন। ওই হামলায় অন্যদের সঙ্গে দুই ইরানি জেনারেল নিহত হন।

এরপর জুলাইয়ে বৈরুতে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে হত্যা করার অনুমোদন দেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে, গত বছরের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস, যা ইসরায়েলের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী হামলা ছিল। দেশটির রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতারই প্রতিফলন ছিল এই হামলা।

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সমাপ্ত হয়েছিল। একবার আন্তর্জাতিক চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধবিরতির জন্য জোর দিতে বাধ্য হয়।

ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলার হিংস্রতা ও মাত্রা, ইসরায়েলি সমাজের ওপর এর প্রভাব ও নিরাপত্তা প্রশ্ন এটিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এই যুদ্ধ সাম্প্রতিক অন্যান্য সংঘাতের একেবারেই বিপরীত হতে চলেছে।

এদিকে, ইসরায়েলকে কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। আর সেগুলো ব্যবহার করে গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের হত্যা করে চলেছে ইসরায়েল। গাজায় অসংখ্য প্রাণহানি ও ফিলিস্তিনিদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ রাজনৈতিকভাবে মার্কিন প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। এই অঞ্চলে আমেরিকার সমালোচকদের ব্যাপক সমালোচনা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অনেক দিন ধরেই গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

এদিকে, এপ্রিলে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সেগুলো প্রতিহত করতে সক্ষম হয় তেল আবিব। এই ঘটনা ইসরায়েলের নিরাপত্তায় দেশটির বৃহত্তর মিত্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকাই স্পষ্ট করেছিল। যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ইসরায়েল।

গাজায় হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধের মধ্যেই, যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই চলতি গ্রীষ্মে হিজবুল্লাহর সঙ্গে আরেকটি সংঘাতে জড়ায় ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ২০ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন, মার্কিন চাপকে উপেক্ষা না করা গেলেও তা ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন, নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনও পদক্ষেপ নেবে না যা তাকে (নেতানিয়াহু) লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। (কেননা, তিনি বিশ্বাস করেন, যে কোনও ক্ষেত্রে আমেরিকার শত্রুদের সঙ্গেই লড়ছেন তিনি।)

সর্বশেষ সংঘাতের বিষয় এলে এটি ভাবা ভুল হবে যে, নেতানিয়াহু ইসরায়েলের রাজনৈতিক মূলধারার বাইরে কাজ করছেন। বরং তার ওপর হিজবুল্লাহ ও ইরানের বিরুদ্ধেও কঠোর হামলার চাপ রয়েছে।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স যখন লেবাননে একটি যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা উত্থাপন করেছ তখন নেতানিয়াহুর বিরোধীসহ দেশটির প্রধান বামপন্থি, এমনকি ডানপন্থি দলগুলোও প্রস্তাবিত ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির সমালোচনা করেছিল।

ইসরায়েল এখন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে এটি এ জন্য নয় যে, দেশটি আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করতে পারে, বরং ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল যে হুমকির প্রতি আর সহনশীল নয় সে জন্যও।

গত কয়েক বছর ধরে উত্তর ইসরায়েলের গ্যালিলে আক্রমণ করার লক্ষ্যের কথা প্রকাশ্যে বলে আসছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি জনগণ যেহেতু এখন বাড়িতে বন্দুকধারীদের অনুপ্রবেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছে, তখন সেই হুমকি আর সহ্য করা নয় বরং, সে ভয় অবশ্যই দূর করা উচিত।

ঝুঁকি নিয়ে ইসরায়েলের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। এই অঞ্চলে দীর্ঘকালের সামরিক রেড লাইনের রাখার ধারণাটিও এখন উড়ে গেছে। গত বছরে এমন বেশ কিছু কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে যা সম্প্রতি তেহরান, বৈরুত, তেল আবিব ও জেরুজালেমে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের বৃষ্টির মতো সর্বাত্মক সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তেহরানে অতিথি হিসেবে অবস্থানকালে হামাসের প্রধানকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এমনকি দেশটি হাসান নাসরাল্লাহসহ হিজবুল্লাহর পুরো নেতৃত্বকেও হত্যা করেছে। সিরিয়ায় কূটনৈতিক ভবনের ভিতরে সিনিয়র ইরানি কর্মকর্তাদেরও হত্যা করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি দেশটি।

তেল আবিবের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলাসহ ইসরায়েলি শহরগুলোতে ৯ হাজারেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন নিক্ষেপ করেছে হিজবুল্লাহ। ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের হুথিরাও থেমে নেই। মধ্য ইসরায়েলের শহরগুলোতে বড় ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছ গোষ্ঠীটি। যদিও এসব হামলার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রতিরোধ করেছে ইসরায়েল।

গত ছয় মাসে ইসরায়েলের ওপর একটি নয় বরং, দুটি হামলা চালিয়েছে ইরান। তখন ৫০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল দেশটি। এই হামলার জবাবের লেবাননে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Download
ঠিকানা: পূর্ব কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ নিবন্ধনের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত