আল্লাহর প্রিয় নবী ইবরাহিম (আ.)-কে বলা হয় “আবুল আম্বিয়া”—অর্থাৎ নবীদের পিতা। তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকেই এসেছেন অসংখ্য নবী ও রাসুল, এমনকি আল্লাহর সর্বশেষ প্রেরিত নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনিও নবী ইবরাহিম (আ.)-এর বংশধর।
ইবরাহিম (আ.) ছিলেন এমন এক নবী, যিনি নিজের ঈমান, আত্মত্যাগ ও দোয়ার মাধ্যমে মানবজাতির জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সন্তানের ঈমানী কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কোরআনে তাঁর জীবনের অনেক দোয়া বর্ণিত হয়েছে, যেখানে তিনি নিজের সঙ্গে নিজের সন্তান ও বংশধরদের জন্যও মঙ্গল কামনা করেছেন। তাঁর এই দোয়ার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় এক স্নেহময় পিতার ভালোবাসা এবং ঈমানের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা।
আনুগত্য ও ঈমানের দোয়া
নবী ইবরাহিম (আ.) দোয়া করেছেন—
رَبَّنَا وَ اجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَیۡنِ لَكَ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِنَاۤ اُمَّۃً مُّسۡلِمَۃً لَّكَ وَ اَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَ تُبۡ عَلَیۡنَا اِنَّكَ اَنۡتَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ
উচ্চারণ: রাব্বানা ওয়াজ‘আলনা মুসলিমাইনি লাকা ওয়া মিন জুররিয়্যাতিনা উম্মাতান মুসলিমাতান লাকা, ওয়া আরিনা মানাসিকানা, ওয়াতুব ‘আলাইনা, ইন্নাকা আন্তাত-তাওয়্বাবুর রাহীম।
অর্থ: হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত জাতি বানান। আমাদের ইবাদতের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিন এবং আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা আল-বাকারা: ১২৮)
এই দোয়ার মাধ্যমে নবী ইবরাহিম (আ.) তাঁর সন্তানদের ঈমান ও আনুগত্যের পথে রাখার তাওফিক চেয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন, সন্তানের প্রকৃত সাফল্য দুনিয়ার নয়—আখিরাতের। আজকের বাবা-মায়েরও উচিত সন্তানের জন্য এমন দোয়া করা, যেন তারা আল্লাহভীরু, অনুগত ও সৎ পথে থাকে।
নামাজের দোয়া
নবী ইবরাহিম (আ.) দোয়া করেছেন—
رَبِّ اجۡعَلۡنِیۡ مُقِیۡمَ الصَّلٰوۃِ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِیۡ رَبَّنَا وَ تَقَبَّلۡ دُعَآءِ
উচ্চারণ: রাব্বিজআলনি মুকীমাস-সালাতি ওয়া মিন জুররিয়্যাতি রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দু‘আ।
অর্থ: হে আমার রব, আমাকে ও আমার সন্তানদের নামাজ কায়েমকারী বানান। হে আমাদের রব, আমার দোআ কবুল করুন। (সুরা ইবরাহিম: ৪০)
নামাজ হলো ঈমানের স্তম্ভ ও আত্মার প্রশান্তি। ইবরাহিম (আ.) তাঁর দোয়ার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন—সন্তানকে নামাজের চর্চায় অভ্যস্ত করা শুধু ধর্মীয় নয়, নৈতিক দায়িত্বও বটে। আজকের সমাজে নামাজ থেকে দূরে সরে যাওয়া তরুণ প্রজন্মের জন্য এই দোয়া এক চেতনার আহ্বান।
নিরাপত্তা ও তাওহিদের দোয়া
رَبِّ اجۡعَلۡ هٰذَا الۡبَلَدَ اٰمِنًا وَّ اجۡنُبۡنِیۡ وَ بَنِیَّ اَنۡ نَّعۡبُدَ الۡاَصۡنَامَ
উচ্চারণ: রাব্বিজআল হাযাল বালাদা আমিনাওঁ ওয়াজনুবনি ওয়া বানিয়্যা আন্না’বুদাল আসনাম।
অর্থ: হে আমার রব, আপনি এ শহরকে নিরাপদ করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তানদের মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন। (সুরা ইবরাহিম: ৩৫)
এই দোয়ার মধ্য দিয়ে নবী ইবরাহিম (আ.) শুধু শারীরিক নিরাপত্তাই নয়, আত্মিক নিরাপত্তার কথাও বলেছেন। তিনি চেয়েছেন, তাঁর সন্তানরা যেন কখনো শিরক বা কুফরিতে লিপ্ত না হয়। আজও এই দোয়া মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য, কারণ মূর্তিপূজা শুধু পাথরের প্রতিমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—যে কিছু মানুষকে আল্লাহর স্মৃতি থেকে বিমুখ করে, সেটিই আধুনিক যুগের “আসনাম”।
রিজিক ও কৃতজ্ঞতার দোয়া
رَبَّنَا لِیُـقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ فَاجۡعَلۡ اَفۡئِدَۃً مِّنَ النَّاسِ تَهۡوِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ وَارۡ زُقۡهُمۡ مِّنَ الثَّمَرٰتِ لَعَلَّهُمۡ یَشۡكُرُوۡنَ
উচ্চারণ: রাব্বানা লিয়ুকিমুস-সালাতা ফাজআল আফইদাতাম মিনান-নাসি তাহউই ইলাইহিম ওয়ারযুকহুম মিনাস সামারাতি লা‘আল্লাহুম ইয়াশকুরূন।
অর্থ: হে আমাদের রব, তারা যেন নামাজ কায়েম করে; আপনি মানুষের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করুন, যেন তারা শুকরিয়া আদায় করে। (সুরা ইবরাহিম: ৩৭)
এই দোয়ার মাধ্যমে ইবরাহিম (আ.) শেখালেন, রিজিক ও সফলতা যেন কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ব্যবহার হয়। তিনি চেয়েছেন তাঁর সন্তানদের রিজিকে বরকত ও সমাজে সুনাম আসুক, যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে এবং আল্লাহর পথে থাকে।
পিতা-মাতার জন্য শিক্ষা
নবী ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়াগুলো কেবল তাঁর সন্তানদের জন্য নয়—সমস্ত যুগের পিতা-মাতার জন্য এক অমূল্য দিকনির্দেশ। সন্তানদের জন্য দোয়া করা মানে শুধু দুনিয়ার সফলতা কামনা নয়; বরং তাদের ঈমান, চরিত্র, নিরাপত্তা ও আখিরাতের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা।
আজকের যুগে যখন সন্তানদের নৈতিক অবক্ষয়, দীন থেকে দূরত্ব ও মানসিক উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন নবী ইবরাহিম (আ.)-এর এই দোয়াগুলো আমাদের শেখায়—
সন্তানকে সঠিক পথে রাখতে দোয়া, তাওহিদ শিক্ষা ও ইবাদতের পরিবেশ অপরিহার্য।