বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল গরুর গাড়ি। একসময় হাটে-বাজারে যাতায়াত, কৃষিপণ্য পরিবহন কিংবা বিয়েশাদি— সবক্ষেত্রেই এই বাহনের ছিল বিশেষ ব্যবহার। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায়, মোটরচালিত যানবাহনের সহজলভ্যতা এবং সময়ের চাহিদার কারণে এখন আর আগের মতো দেখা মেলে না গরুর গাড়ির। এক সময়ের গর্বিত ঐতিহ্য আজ কেবল গল্পে ও স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে গরুর গাড়ির সম্পর্ক ছিল আন্তরিক ও বাস্তবভিত্তিক। একজন কৃষকের জীবনে যেমন জমি চাষ ও ফসল উৎপাদন ছিল মুখ্য, তেমনি ফসল বাজারে নেওয়া, পণ্য আনা–নেওয়ার কাজে গরুর গাড়ির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। গ্রামের সকাল শুরু হতো গরুর গাড়ির ঘণ্টাধ্বনিতে, আর সন্ধ্যায় মাটির পথে চলতে চলতে তার চাকার কড়মড় শব্দ শুনে বোঝা যেত, ফসলের মৌসুম চলছে। কিন্তু এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না।
প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং দ্রুতগামী জীবনের চাপে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই ঐতিহ্যবাহী বাহনটি। যেখানে আগে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র পরিবহন, সেখানে এখন মোটরসাইকেল, ভ্যান, ট্রাক, অটোরিকশা কিংবা পিকআপ ভ্যান সহজলভ্য। সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয়েছে, চাহিদাও বেড়েছে। ফলে ধীরগতির গরুর গাড়ির জায়গা নিয়েছে দ্রুতগতির আধুনিক যানবাহন।
তবে গরুর গাড়ি শুধু বাহনই নয়, এটি ছিল পরিবেশবান্ধব এক মাধ্যম। এতে কোনো ধোঁয়া নেই, নেই শব্দ দূষণ। অথচ আজ আমরা যে যান্ত্রিক বাহন ব্যবহার করছি, সেগুলোই পরিবেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। আধুনিকতার দৌড়ে মানুষ যেমন স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছে, তেমনি হারাচ্ছে প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সংস্পর্শ।
গরুর গাড়ির বিলুপ্তি শুধু যাতায়াত ব্যবস্থায় নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। আগে কাঠমিস্ত্রি, কামার, চর্মশিল্পী— অনেকেই এই গাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এটি একধরনের গ্রামীণ শিল্পও ছিল। এখন সে সব মানুষ অন্য পেশায় বাধ্য হয়ে চলে গেছেন। এক অর্থে গরুর গাড়ির হারিয়ে যাওয়া মানে একটি পেশার বিলুপ্তিও।
আজও দেশের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে হয়তো গরুর গাড়ির দেখা মেলে, তবে তা আর আগের মতো নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা এখন কেবল স্মৃতি ধরে রাখার প্রয়াসে বা ঐতিহ্যিক উৎসবের প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত হয়। অথচ চাইলে এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা সম্ভব। স্থানীয় পর্যায়ে মেলা, উৎসব কিংবা স্কুলের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে গরুর গাড়িকে তুলে ধরা যেতে পারে। সরকার চাইলে গ্রামীণ ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশ হিসেবে গরুর গাড়ি সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনে পদক্ষেপ নিতে পারে।
গরুর গাড়ি হারিয়ে যাওয়া মানে এক সময়ের গ্রামীণ জীবনের রঙ হারিয়ে যাওয়া। এটি শুধু একটি বাহনের বিলুপ্তি নয়, বরং এক প্রজন্মের অনুভূতি, এক সংস্কৃতির মৃত্যু। আধুনিকতার এই যুগে আমাদের উচিত ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রযুক্তির ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে জাতি তার শেকড় হারায়।
বাংলার মাটিতে আবার যদি শোনা যেত গরুর গাড়ির ঘণ্টাধ্বনি, যদি দেখা যেত গ্রামের পথে মাটির ধুলো উড়িয়ে চলা সেই দৃশ্য — তবে হয়তো আমরা বুঝতে পারতাম, সত্যিকারের সৌন্দর্য কীভাবে মিশে ছিল আমাদের ঐতিহ্যে। গরুর গাড়ি হয়তো এখন অতীত, কিন্তু এর স্মৃতি আজও বেঁচে আছে গ্রামীণ মানুষের হৃদয়ে।