লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দ

আরেফিন সোহাগ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, এজেড নিউজ বিডি
লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দ
লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দ

একসময় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল লাটিম। ছোট থেকে বড় সকলেই এই খেলায় আনন্দ খুঁজত, যা শুধু শারীরিক পরিশ্রম নয়, সামাজিক বন্ধন ও দলবদ্ধ কাজ শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবেও বিবেচিত হত। কিন্তু আজকের দিনে, আধুনিক প্রযুক্তি, মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম, এবং শহুরে জীবনের ব্যস্ততার কারণে লাটিম খেলা প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রামাঞ্চলের খোলা মাঠগুলো এখন যেমন কমে এসেছে, তেমনি শিশুদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহও কমে গেছে।

লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দের অংশ। ছোটবেলায় আমরা সকলে মাঠে দাঁড়িয়ে লাটিম ঘোরাতাম, বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতাম এবং কখনও জয়, কখনও পরাজয় স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতাম। এই খেলার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত, সঠিকভাবে দৌড়ানো, সমন্বয়পূর্ণ কাজ, ধৈর্য এবং মনোযোগও শেখার সুযোগ মিলত। সামাজিক দিক থেকেও লাটিম শিশুদের মধ্যে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং দলের মধ্যে কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে হয় তা শেখাত।

গ্রামের প্রবীণরা জানান, আগে দুপুরের খাবারের পর ছেলেমেয়েরা মাঠে লাটিম খেলতে বের হত, সন্ধ্যার আগে কেউ বাড়ি ফিরত না। “আমরা ছোটবেলায় লাটিম ছাড়া বিকেল কল্পনা করতে পারতাম না। এখনকার বাচ্চারা মাঠে আসে খুব কম, হাতে শুধু মোবাইল,” বললেন এক গ্রামবাসী। এই পরিবর্তনের ফলে শুধু খেলার আনন্দই কমছে না, বরং গ্রামের ঐতিহ্যও বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আধুনিক সময়ের শিশুদের ব্যস্ত জীবন এবং প্রযুক্তির আসক্তি তাদের প্রাকৃতিক খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। তারা বলেন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য লাটিমের মতো খেলাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকলে শিশুদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তাদের ঘাড়, পা ও হাতের মাংসপেশি শক্তিশালী হয়, এবং মানসিক চাপও কমে। আবার দলবদ্ধ খেলার মাধ্যমে তারা নেতৃত্ব, সহযোগিতা এবং নৈতিক গুণাবলী শেখে।

কিন্তু শুধু স্বাস্থ্য বা শারীরিক উপকারের বিষয় নয়; লাটিম খেলাই ছিল গ্রামের সামাজিক বন্ধন জোরদার করার মাধ্যম। গ্রামে একত্রিত হয়ে খেলার সময় বাবা-মা, দাদা-দাদি এবং প্রতিবেশীরা সবাই মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করতেন। এই মিলন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। বর্তমানে শহরের শিশুরা এই ধরনের সামাজিক বন্ধন থেকে দূরে। তারা খেলাধুলার পরিবর্তে অনলাইন গেম বা সামাজিক মাধ্যমের প্রতি বেশি আকৃষ্ট।

এছাড়া, লাটিম খেলার হারানোর পেছনে খেলার জন্য পর্যাপ্ত খোলা মাঠের অভাবও একটি বড় কারণ। গ্রামগুলোতে অনেক জায়গা এখন ব্যক্তিগত বসতি বা কৃষিজমি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, আর শহরে খেলার জন্য জায়গার অভাব শিশুদের খেলাধুলা কমিয়ে দিয়েছে। শিশুদের বিকাশের জন্য প্রয়োজন খোলা জায়গা, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে দৌড়াতে, লাফাতে এবং খেলতে পারে।

স্থানীয় স্কুল ও কমিউনিটি নেতারা বলছেন, নিয়মিত লাটিম প্রতিযোগিতা আয়োজন করলে এই হারানো ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। স্কুলগুলোতে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধি, টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং শিশুদের খেলাধুলার গুরুত্ব বোঝানো গেলে, তারা প্রাকৃতিকভাবে লাটিমের মতো খেলায় আগ্রহী হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, পরিবারগুলোও যদি সন্ধ্যা সময়ে শিশুদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে খেলে, তাহলে শিশুদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনও দৃঢ় হবে।

বিলুপ্তির পথে থাকা লাটিম শুধু একটি খেলার বিষয় নয়; এটি শিশুদের শৈশবের একটি স্মৃতি, গ্রামের সামাজিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। এই খেলা হারালে কেবল আনন্দের জায়গা নয়, বরং এক প্রজন্মের সামাজিক ও শারীরিক বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বর্তমান প্রজন্মকে লাটিমের আনন্দ উপভোগ করতে এবং এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে উৎসাহিত করা জরুরি।

উপসংহারে বলা যায়, লাটিম হারানো মানে হারানো শৈশবের আনন্দ, গ্রামীণ ঐতিহ্য এবং সামাজিক বন্ধনের একটি মূল্যবান অংশ। যদি আমরা সকলে সচেতন হই এবং শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ দিই, নিয়মিত প্রতিযোগিতা ও উৎসব আয়োজন করি, তাহলে আগামী প্রজন্মও লাটিম খেলার আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। খেলার মাধ্যমে শিশুরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবে, মানসিকভাবে উদ্যমী হবে এবং সামাজিকভাবে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলবে। লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য রত্ন।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দ

লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দ
লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দ

একসময় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল লাটিম। ছোট থেকে বড় সকলেই এই খেলায় আনন্দ খুঁজত, যা শুধু শারীরিক পরিশ্রম নয়, সামাজিক বন্ধন ও দলবদ্ধ কাজ শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবেও বিবেচিত হত। কিন্তু আজকের দিনে, আধুনিক প্রযুক্তি, মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম, এবং শহুরে জীবনের ব্যস্ততার কারণে লাটিম খেলা প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রামাঞ্চলের খোলা মাঠগুলো এখন যেমন কমে এসেছে, তেমনি শিশুদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহও কমে গেছে।

লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি ছিল শৈশবের আনন্দের অংশ। ছোটবেলায় আমরা সকলে মাঠে দাঁড়িয়ে লাটিম ঘোরাতাম, বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতাম এবং কখনও জয়, কখনও পরাজয় স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতাম। এই খেলার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত, সঠিকভাবে দৌড়ানো, সমন্বয়পূর্ণ কাজ, ধৈর্য এবং মনোযোগও শেখার সুযোগ মিলত। সামাজিক দিক থেকেও লাটিম শিশুদের মধ্যে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং দলের মধ্যে কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে হয় তা শেখাত।

গ্রামের প্রবীণরা জানান, আগে দুপুরের খাবারের পর ছেলেমেয়েরা মাঠে লাটিম খেলতে বের হত, সন্ধ্যার আগে কেউ বাড়ি ফিরত না। “আমরা ছোটবেলায় লাটিম ছাড়া বিকেল কল্পনা করতে পারতাম না। এখনকার বাচ্চারা মাঠে আসে খুব কম, হাতে শুধু মোবাইল,” বললেন এক গ্রামবাসী। এই পরিবর্তনের ফলে শুধু খেলার আনন্দই কমছে না, বরং গ্রামের ঐতিহ্যও বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আধুনিক সময়ের শিশুদের ব্যস্ত জীবন এবং প্রযুক্তির আসক্তি তাদের প্রাকৃতিক খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। তারা বলেন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য লাটিমের মতো খেলাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকলে শিশুদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তাদের ঘাড়, পা ও হাতের মাংসপেশি শক্তিশালী হয়, এবং মানসিক চাপও কমে। আবার দলবদ্ধ খেলার মাধ্যমে তারা নেতৃত্ব, সহযোগিতা এবং নৈতিক গুণাবলী শেখে।

কিন্তু শুধু স্বাস্থ্য বা শারীরিক উপকারের বিষয় নয়; লাটিম খেলাই ছিল গ্রামের সামাজিক বন্ধন জোরদার করার মাধ্যম। গ্রামে একত্রিত হয়ে খেলার সময় বাবা-মা, দাদা-দাদি এবং প্রতিবেশীরা সবাই মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করতেন। এই মিলন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। বর্তমানে শহরের শিশুরা এই ধরনের সামাজিক বন্ধন থেকে দূরে। তারা খেলাধুলার পরিবর্তে অনলাইন গেম বা সামাজিক মাধ্যমের প্রতি বেশি আকৃষ্ট।

এছাড়া, লাটিম খেলার হারানোর পেছনে খেলার জন্য পর্যাপ্ত খোলা মাঠের অভাবও একটি বড় কারণ। গ্রামগুলোতে অনেক জায়গা এখন ব্যক্তিগত বসতি বা কৃষিজমি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, আর শহরে খেলার জন্য জায়গার অভাব শিশুদের খেলাধুলা কমিয়ে দিয়েছে। শিশুদের বিকাশের জন্য প্রয়োজন খোলা জায়গা, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে দৌড়াতে, লাফাতে এবং খেলতে পারে।

স্থানীয় স্কুল ও কমিউনিটি নেতারা বলছেন, নিয়মিত লাটিম প্রতিযোগিতা আয়োজন করলে এই হারানো ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। স্কুলগুলোতে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধি, টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং শিশুদের খেলাধুলার গুরুত্ব বোঝানো গেলে, তারা প্রাকৃতিকভাবে লাটিমের মতো খেলায় আগ্রহী হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, পরিবারগুলোও যদি সন্ধ্যা সময়ে শিশুদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে খেলে, তাহলে শিশুদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনও দৃঢ় হবে।

বিলুপ্তির পথে থাকা লাটিম শুধু একটি খেলার বিষয় নয়; এটি শিশুদের শৈশবের একটি স্মৃতি, গ্রামের সামাজিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। এই খেলা হারালে কেবল আনন্দের জায়গা নয়, বরং এক প্রজন্মের সামাজিক ও শারীরিক বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বর্তমান প্রজন্মকে লাটিমের আনন্দ উপভোগ করতে এবং এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে উৎসাহিত করা জরুরি।

উপসংহারে বলা যায়, লাটিম হারানো মানে হারানো শৈশবের আনন্দ, গ্রামীণ ঐতিহ্য এবং সামাজিক বন্ধনের একটি মূল্যবান অংশ। যদি আমরা সকলে সচেতন হই এবং শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ দিই, নিয়মিত প্রতিযোগিতা ও উৎসব আয়োজন করি, তাহলে আগামী প্রজন্মও লাটিম খেলার আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। খেলার মাধ্যমে শিশুরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবে, মানসিকভাবে উদ্যমী হবে এবং সামাজিকভাবে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলবে। লাটিম কেবল একটি খেলা নয়; এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য রত্ন।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Download
ঠিকানা: পূর্ব কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ নিবন্ধনের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত