জাতীয় মাছ ইলিশ। এটি শুধু স্বাদের নয়, বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার স্রোতে ভেসে বেড়ানো রূপালি এই মাছ বাঙালির প্লেটে যেমন রাজকীয় আসন দখল করে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না ইলিশের জীবনের অনেক রহস্য, যা প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
ইলিশ মূলত সমুদ্রের মাছ, কিন্তু ডিম পাড়ার সময় তারা নোনা পানি ছেড়ে মিঠা পানির নদীতে চলে আসে। এই যাত্রাকে বলা হয় ‘প্রজনন যাত্রা’। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ডিম পাড়ার পর অনেক মা ইলিশ সমুদ্রে ফিরে যায়, আবার কেউ কেউ মারা যায়। প্রকৃতির এই নিয়মেই নতুন প্রজন্মের জন্ম হয় এবং নদীভরা রূপালি ঝলকানি ফিরে আসে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ইলিশ মাছের একটি অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে—তারা পানির গন্ধ চিনে পথ খুঁজে নেয়। যে নদীতে জন্ম নিয়েছিল, বড় হয়ে সেই নদীতেই ফিরে আসে ডিম পাড়তে। পানির গন্ধ, তাপমাত্রা, ও প্রবাহ চিনে তারা সমুদ্র থেকে শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। এটি প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়।
বাংলাদেশ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষে। প্রতিবছর দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। এ মাছ শুধু ঘরোয়া খাবার নয়, রপ্তানিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসে ইলিশ রপ্তানির মাধ্যমে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, অতিরিক্ত মাছ ধরা, নদীর দখল ও দূষণ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। এজন্য সরকার প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে, বিশেষ করে অক্টোবর মাসে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান’ পরিচালনা করা হয়। এই উদ্যোগে ইতিমধ্যে ইতিবাচক ফলও পাওয়া যাচ্ছে।
পদ্মার ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে বেশি বলে ধরা হয়, কারণ পদ্মার পানির গঠন ও খনিজ উপাদান এর মাংসকে করে তুলেছে অনন্য সুস্বাদু। ভাজা, ঝোল, দোপেঁয়াজা, কিংবা পাতুরি—যেভাবেই রান্না করা হোক, ইলিশ বাঙালির রুচি ও আবেগের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
ইলিশ কেবল এক প্রজাতির মাছ নয়; এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতীয় গর্বের প্রতীক। তাই ইলিশ সংরক্ষণ মানে কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ রক্ষা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বড় দায়বদ্ধতা।