গাইবান্ধার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় দিনদিন বেড়েই চলেছে ভুট্টার আবাদ। এ বছরে দেখা দিয়েছে বাম্পার ফলন। তাই রবি মৌসুমে ১ লাখ ৯০ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
সম্প্রতি গাইবান্ধার চরাঞ্চলসহ অন্যান্য এলাকা দেখা গেছে, ভুট্টা ক্ষেতে সবুজের সমাহার। ধু-ধু বালুচরে এই ক্ষেত থেকে ইতোমধ্যে পরিপক্ক ভুট্টা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছর ভুট্টা থেকে ভালো লাভ করতে পারবেন বলে স্বপ্ন দেখছেন কৃষক।
পলাশবাড়ী উপজেলার করতোয়া ও মৎস নদের বুকে জেগে ওঠা সাড়ি সাড়ি ভুট্টার গাছ যেন সবুজের চাদরে ঢেকে দিয়েছে। চলতি মৌসুমে পলাশবাড়ীর ১টি পৌরসভা এবং ৮ ইউনিয়নে মোট ১ হাজার ২শ’ ৬৫ হেক্টর জমিতে ভূট্টার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ হাজার ৯’শ ৫৭ মেঃ টন। তবে ল্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়। গাইবান্ধা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি রবি মৌসুমে জেলায় ১৭ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষাবাদ হয়েছে।
যার উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৯০০ মেট্রিকটন। তবে গত বছর ভুট্টা চাষ হয়েছিল ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টর। এর মধ্যে চরাঞ্চলে ছিল ১০ হাজার ৭০০ হেক্টর। এ বছরে চরাঞ্চলে ১১ হাজার হেক্টর রয়েছে। কৃষকরা ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় ভুট্টার আবাদ বেড়েছে অনেকটা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নদী বেষ্টিত জেলা গাইবান্ধা। এ জেলার বুক চিড়ে বয়ে গেছে, ঘাঘট-ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-যমুনাসহ অসংখ্য নদ-নদী। এসব নদীর বুকে জেগে উঠেছে শতাধিক বালুচর। এইসব চরাঞ্চলে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ভুট্টার আবাদেই যেন কৃষকের সোনার ফসল। স্বল্প খরচে অধিক লাভজনক হওয়ায় এখানকার কৃষকরা ঝুঁকে পড়েছে ভুট্টা চাষে। শুধু চরাঞ্চলের কৃষকরায় নয়, জেলার বিভিন্ন সমতল ভূমিতে এই আবাদ চোখে পড়ার মতো। এটিই তাদের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকারি ফসল। চলতি রবি মৌসুমে বপন করা ভুট্টা ক্ষেতে ইতোমধ্যে থোর বেড়িয়ে রঙ বদলাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও এই ফসল ঘরে তোলাও শুরু করছে কৃষকরা।
কামারজানি চরের কৃষক মোতালেব মিয়া জানান, এ বছর বালুভূমিতে পৌনে দুই একর ভুট্টা আবাদ করেছেন। আর কয়েকদিন পর এ ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। এখান থেকে খরচ বাদে প্রায় লক্ষাধিক টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
সাদুল্লাপুর চরাঞ্চলের কৃষক রাজু শেখ বলেন, এ বছর ১ একর জমিতে ভুট্টা আবাদ করে সেই ফসল ঘরে তোলা হচ্ছে। হাইব্রিড সারা-৩০৫৫ জাতের ভুট্টা বিঘাপ্রতি ২৮ থেকে ৩০ মণ পেয়েছি। এতে বিঘাপ্রতি তার খরচ হয়েছে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারে ১ হাজার টাকা মণ দামে শুকনো ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে।
আরেক কৃষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, ভুট্টা চাষ অনেকটা লাভজনক। কিন্তু কৃষি অফিসের প্রণোদনা ও পরামর্শ পেলে আরও লাভবান হওয়া সম্ভব। কিন্তু সরকারের কোনো সুবিধা আজও কপালে জোটেনি।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের জাফর, মুংলিশপুর, পশ্চিম নয়ানপুর, বেড়াডাঙ্গা, তেকানী, চকবালা, কিশোরগাড়ী, বড় শিমুলতলা, বুজরুক টেংরা, খোর্দ্দটেংরা, সগুনা, পশ্চিম রামচন্দ্রপুর, গণেশপুর, সুলতানপুর বাড়াইপাড়া, দিঘলকান্দি, ফলিয়া, আসমতপুর, বেংগুলিয়া, হোসেনপুর ইউনিয়নের করতোয়াপাাড়া, হোসেনপুর, শিশুদহ, খাসবাড়ী, চেরেঙ্গা, কিশামত চেরেঙ্গা, আকবরনগর, রামকৃষ্ণপুর, পশ্চিম ফরিদপুর, কলাগাছি, করিয়াটা, শালমালা, কয়ারপাড়া, রামচন্দ্রপুর, পলাশবাড়ী ইউনিয়নের পশ্চিম গোয়ালপাড়া, নুরপুর, হিজলগাড়ী, ছোট সিধনগ্রাম, ছোটশিমুলতলা, বাঁশকাটা, মহেশপুর ছাড়াও উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়ন গুলোতে এবারে ব্যাপক ভুট্টার চাষ হয়েছে। উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের চকবালা গ্রামের ভুট্টাচাষী আঃ হামিদ, কিশোরগাড়ীর আনারুল ইসলাম ও সগুনার শামীম মিয়া বলেন, প্রতি বছর আমরা আগাম জাতের ভুট্টার চাষ করে থাকি। ভুট্টার চাষ কম বেশি যাই হোক না কেন সেটা বিষয় নয়। চাই ভুট্টার সুষ্ঠু বাজার দর। সরকারীভাবে ভুট্টার বাজার দর বেধে দিলে কৃষকরা উপকৃত হবেন।
কৃষকরা আরো বলেন, এ উপজেলায় হাইব্রিড জাতের সুপার সাইন ২৭৫৫, ৭৬০, কাবেরি ৫৪, প্যাসিফিক ৫৫৫, ৯৮৪, সিনজেন্টা এনএইচ ৭৭২০, ডিকাল্ব ৯১২০, ৯১৬৫ জাতের ভূট্টার ফলন বেশি হয়ে থাকে। ভুট্টা চাষে সেচ, সার ও কীটনাশক খুব বেশি দরকার পড়ে না বিধায় একদিকে খরচ কম অন্যদিকে ফলনও বেশি। কারণ হিসেবে ভূট্টা চাষীরা আরো বলেন, ভরা মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেও এ ফসলের তেমন একটা তি হয় না। কিন্তু অন্যান্য ফসলে কৃষকরা আর্থিকভাবে লোকসানের সম্মুখীন হন। অন্যদিকে রবি মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়লেও ভুট্টার ফলন তুলনামূলক ভালো পাওয়া যায়। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে কৃষকরা বিঘা প্রতি ২৬ থেকে ৩২ মণ ভুট্টার ফলন পেতে পারে যার বর্তমান বাজার মূল্য মণ প্রতি ৯০০ থেকে ১০২০ টাকা। কৃষকদের আশা, সরকারিভাবে কৃষি বিভাগ যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ভুট্টা চাষ হয়েছে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাজমা বেগম, ভুট্টা আবাদ অত্যন্ত লাভজনক। ভুট্টার দানা মানুষের পুষ্টিখাদ্য, গাছ ও সবুজ পাতা গোখাদ্য এবং হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, এ জেলার কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী বেশি। তাদের লাভবান করতে মাঠপর্যায়ে সার্বিব সহযোগিতা করা হচ্ছে।