লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর রায়পুর সড়কের পূর্বপাশে বিশাল আয়তনের একটি দিঘী রয়েছে, যার নাম খোয়া সাগর দিঘী। খোয়া মানে কুয়াশা অর্থাৎ দীঘিটি আয়তনে এতই দীর্ঘ যে এর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে তাকালে কুয়াশাময় মনে হয় বলে এর নামকরণ হয় খোয়া সাগর। দুই শতাধিক বছর পূর্বে আশপাশের এলাকা মাটি ভরাট এবং মানুষের ব্যবহারের জন্য পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনে দালাল বাজারের জমিদার ব্রজবল্লভ রায় দীঘিটি খনন করেন।
পর্যটন মন্ত্রণালয় ও লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের অর্থায়নে দিঘীর উত্তর ও পশ্চিমের একাংশ প্যালাসাইটিং দিয়ে পর্যটকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য কয়েকটি পাকা বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়। সৌন্দর্য রক্ষার্থে একটি গোলঘর নির্মাণ করা হয় খোয়াসাগর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে। এছাড়া বসার জন্য বেশ কয়েকটি পাকা বৃত্তাকার বেঞ্চ রয়েছে। বসার স্থানে সড়কের পাশে ১৩টি সোলার ল্যাম্পপোস্ট লাগানো হয়।
লকডাউনের মধ্যেও ঈদকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজার খোয়া সাগর দিঘির পাড়ে নানা বয়সি মানুষের উপচে পড়া ভীড় শুরু হয়েছে গত ২ বছর আগে থেকে।
জেলার রামগতির কমল নগর, রামগঞ্জ, রায়পুর,চন্দ্রগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর থেকে বেড়াতে আসা শিশু-কিশোর যুবক-যুবতীরা আক্ষেপ করে বলেন, দূরদূরান্ত থেকে আমরা ঘুরতে আসি ঠিকই কিন্তু ঘুরতে এসে পড়তে হয় বিপদে। চেনা নেই জানা নেই দলে দলে বখাটে ছেলেরা এসে আমাদেরকে প্রশ্ন করে আমাদের কে বিভ্রান্ত করে। কে আমরা কেন আসছি বাড়ি কোথায় সাথে নিজের ভাই থাকলে ও প্রশ্ন করে উনি কে তোমার কি হয় এরকম উদ্ভট প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায় বিকাল বেলা স্বামী-স্ত্রী, ভাই বোন, বন্ধু- বান্ধবী, বোন ভগ্নিপতি বাসায় আগত মেহমানদের কে নিয়ে যখন এই খোয়া সাগর দিঘীর পাড়ে বেড়াতে আসে তাদেরকে পরতে হয় কোন না কোন ঝামেলায়। হঠাৎ একজন আসেন এসে নানা প্রশ্ন জড়িয়ে দেন তারপর আস্তে আস্তে দুজন তিনজন করে জড়ো হতে থাকে ৮ থেকে ১০ জন্য বখাটের একটি টিম। এবং ভাষা গত ভাবে ঘুরতে আসা যুবক-যুবতীদেরকে অপমান অপদস্থ করতে শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের হাতের মোবাইল নগদ টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। আর এরা হচ্ছে হেবা কমেটির সদস্য। আর এই হেবা কমেটির সদস্যরা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে তাৎক্ষণিক বাহিনীর প্রধান ফোন করেন স্থানীয় দালাল বাজার ফাঁড়িতে। মাত্র ১০ – ১৫ মিনিটের মধ্যেই প্রশাসনের লোকজন চলে আসেন খোয়া সাগরদিঘির পারে ঘটনাস্থলে। এর পর হেবা কমিটির সদস্যরা অনেকেই তাদের দলীয় পরিচয় দেন ।
এক পর্যায়ে প্রশাসন অথবা ফাঁড়ির আই সি যুবক-যুবতীদেরকে হেবা কমেটির সদস্যদের সাথে কথা বলে দালালবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে যান। সাথে সাথে হেবা কমিটির সদস্যরা দালাল বাজার ফাঁড়িতে অবস্থান নেন। ক্ষুদ ফাঁড়ি আইসির সামনেই বসে শুরু হয় দরকষাকষি। হেবা কমিটি সদস্যদের চাহিদা ৫০.০০০ সর্বনিম্ন ৩০.০০০ দিতে হবে। টাকা পয়সা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে এক পর্যায়ে ব্ল্যাকমেন করা শুরু করে। মামলার ভয় দেখায়। কোনভাবেই যদি টাকা-পয়সার দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে না পারে তখন যুবক যুবতীর স্বামী-স্ত্রীর ফোন নাম্বার চাই অথবা বাবা-মায়ের ফোন নাম্বার চাই।
সম্প্রতি ৪ দিন আগের ঘটনা। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, আপন বড় ভাই তার ছোট বোনকে লক্ষ্মীপুর উত্তর ইস্টিশনে নিজের চালিত বাইক থেকে নামিয়ে সিএনজি অটোরিকশা যোগে দালাল বাজার তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠিয়ে দেন। এরই মাঝে দালাল বাজার খোয়া সাগরদিঘির পারে গেলে ছোট বোনের স্কুল জীবনের বন্ধুর সাথে দেখা হয়। অনেকদিন পরে দেখার পর দুই ক্লাসমেট দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলা অবস্থায় দুজনের উপরের শোয়ার হয় হেবা কমিটির সদস্যরা। ঘটনাস্থলেই দুই ক্লাসমেটকে নাজেহাল করা শুরু করে এবং মারধর করে। মিনিটে জড়ো হলো প্রায় ৩০ থেকে ৫০ জন লোক। সবাই দূর থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে কি ঘটনা হচ্ছে ওখানে। অতঃপর পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে দালাল বাজার ফাঁড়ির আইসি সালাউদ্দিন শামীম কে ফোন করে হেবা কমেটির সদস্যরা। দুই ক্লাসমেটকে হেবা কমেটির সদস্যরা মিথ্যা অপবাদ ও সাজানো নাটক সাজিয়ে ফাঁড়ির আইসির হাতে তুলে দেন। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় দালালবাজার ফাঁড়িতে।
একটি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়ার পর সংবাদকর্মীরা ছুটে যান দালাল বাজার ফাঁড়িতে। কি ঘটনা ঘটেছিল ব্যাপারটা জানতে চাইলে ক্ষুদ ফাঁড়ি আইসি সালাউদ্দিন শামিমের সামনেই বসে হেবা কমেটির সদস্যরা নাজেহাল করেন সংবাদকর্মীদের কে। অতঃপর দেখা গেল হেবা কমিটির সদস্যরা আইসি শামিমের সাথে যোগাযোগ করে শুরু করছে দর কষাকষি।
লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোসলেউদ্দিন ঘটনাটি জানার পর দালালবাজার ফাঁড়ি থানা থেকে দুই ক্লাসমেটকে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন আইসি শামিম কে।
দালাল বাজার ফাঁড়ি থেকে আইসি শামিম সদর থানা নিয়ে আসেন ক্লাসমেট দুজনকে, ওসি সদর থানা দুজনের কথা শুনে তাদের কে সম্মানের সহিত থানায় থেকে বিদায় দেন।
স্থানীয়রা জানায়, এতদিন খোয়া সাগর দিঘির পাড়ে সাধারণ মানুষের বিনোদনের জায়গা হলেও বর্তমানে উচ্ছৃঙ্খল তরুণ, মাদক সেবি, মাদক ব্যবসায়ী, জুয়া খেলোয়াড়দের আড্ডা খানায় পরিণত হয়েছে খোয়া সাগর দিঘির পাড়।
খোয়া সাগর দিঘির পাড়ে এসে অনেক যুবক এখানে সেখানে বসে দল বেধে মোবাইলে ইন্টারনেট জুয়া খেলায় লিপ্ত হচ্ছে। এমন উচ্ছৃঙ্খল তরুণদের ভয়ে আতংকে থাকছে সাধারণ দর্শনার্থী ও এলাকার মানুষ। উচ্ছৃঙ্খল তরুণরা মেয়েদের কে কুরুচিপূর্ণ কথা বলতেও দেখা গেছে। প্রতিবাদ করলে অনেক তরুণরা দল বেধেঁ একাএকি দর্শনার্থীদের বিরুদ্ধে তেড়ে আসে।
কালিবাজার থেকে ঘুরতে আসা ব্যবসায়ী মুরাদ বলেন, একটু যে আরামে কোথাও ঘুরে বেড়াবেন, তারও কোনো উপায় নেই। যতই দিন যাচ্ছে, ততই যেন বখাটেদের উৎপাত বাড়ছে। ঝামেলা এড়াতে এসব উত্ত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতেও চান না।’
রায়পুরের দর্শনার্থী আল আমিন জানান, এধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে দালাল বাজার খোয়াসাগর পর্যটন কেন্দ্র। মাঝে মাঝে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা ঘটছে কিশোরগ্যাং সদস্যদের মাঝে।
আলআমিন আক্ষেপ করে বলেন, বছরখানেক আগেও খোয়াসাগরদীঘির পাড় লোকে লোকারণ্য ছিল এখন পর্যটন সেরকম একটা আসে না। কারন খোয়াসাগর দিঘি পাড় এখন দখল করে আছে কিশোর গ্যাং ও হেবা কমেটির সদস্যরা।
তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক জনাব আনোয়ার হোসেন আকন্দ এবং লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ সুপার জনাব মাফুজ্জামান আশরাফ দালাল বাজার খোয়া সাগর দিঘির পর্যটন কেন্দ্রের দিকে যদি সুদৃষ্টি দেন, তাহলে হয়তোবা ফিরে পেতে পারে খোয়াসাগর দিঘি পর্যটন কেন্দ্র তার হারানো ঐতিহ্য।