কার্তিক মাসে দেবী দুর্গার বিদায়ের পর প্রকৃতি সাজতে শুরু করেছে নতুন রূপে। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ কুয়াশা আর ভোরবেলা ঘাসে জমতে থাকা শিশির জানান দিচ্ছে ষড়ঋতুর দেশে শীতকাল আসছে। শিশিরে জড়ানো মাকড়সার জাল আর ভোরের সজীবতা নিয়ে প্রকৃতি কাছে টানছে মানুষকে।
পৌষ ও মাঘ এই দুইয়ে মিলে শীতকাল। তবে হেমন্তকালের শেষেই আভাস পাওয়া যায় শীতের। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময়ের শীতল বাতাস প্রকৃতিকে জানান দেয় শীতের আগমনী বার্তার। সদ্য প্রেমে পরা পুরুষের চোখে তার প্রেমিকা যতোটা সুন্দর, শীত আসছে আসছে ভাব এমন প্রকৃতি তেমনই সুন্দর।
সন্ধ্যা হলেই কুয়াশার স্নিগ্ধ গন্ধে শুভ্রতা ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। শীতল বাতাস কাঁপুনি উঠিয়ে দেয় শরীরে। বাতাসে বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা। ধীরে ধীরে শীত নামছে এমন প্রকৃতি মারাত্মক সুন্দর। শীতকালের জন্য অপরুপ সৌন্দর্যে সাজছে চারপাশ।
কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাওয়া শীতকালের অপেক্ষায় থাকে প্রকৃতিপ্রেমীরা। ঠিক তেমনি শীতকালের অপেক্ষায় থেকে কবি ভাস্কর চক্রবর্তী তার কবিতায় লিখেছেন, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো’। কবি আর প্রকৃতিপ্রেমীদের অপেক্ষার পালা শেষ হতে চললো কারণ দরজায় কড়া নাড়ছে শীতকাল।
ঘরে ঘরে চলছে শীতকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি। আলমারি থেকে লেপ, কাথা-কম্বল আর শীতের পোশাক বের করে ধুয়ে শুকানো হচ্ছে রোদে। মার্কেট থেকে নতুন সোয়েটার, জ্যাকেট, হুডি, টুপি, মুজা আরো বাহারি ডিজাইনের গরম পোশাক কিনছে সবাই। ঘন কুয়াশা প্রকৃতিকে ঢেকে ফেলার সাথে সাথে আমরাও শীতের পোশাকে মুড়িয়ে নিবো আমাদের।
কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে উড়ে বেড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সাদা বক। সকালের মিষ্টি রোদে পাখা মেলে উড়বে পাখিরা। কুয়াশায় ঢেকে থাকবে সূর্য। সন্ধ্যা হলেই শুনশান নিরব হয়ে যাবে পরিবেশ। উত্তরের ঠান্ডা বাতাসে চারপাশ কনকন করবে শীতে। শীতকালীন ফুল সূর্যমুখী, জবা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আরো নানান ফুল মুগ্ধতা ছড়াবে।
হাড় হিম করা ঠান্ডা রাতের পর সকালের চিলতে মৃদু রোদ এনে দিবে শান্তির পরশ। বারান্দায় কিংবা দুয়ারে দাড়িয়ে সূর্যের নরম তাপ গায়ে মাখবে সবাই। শীতকে উপেক্ষা করেই কর্মজীবী মানুষরা বেরিয়ে পরবে কাজে। কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই ফিরবে বাড়ি।
আসছে খেজুরের রস খাওয়ার দিন। শীতকালে খেজুরের রসের স্বাদ অমৃত। রাতে গাছে বেধে রাখা হয় মাটির কলস। সারারাত টপটপ করে খেজুরের রসে ভর্তি হয় কলস। রসের স্বাদ নিতে হলে ভোর বেলা যেতে হয় রস বিক্রেতার কাছে। খেজুরের রস থেকে বানানো হয় গুড়। গুড় দিয়ে বানানো হয় সুস্বাদু পিঠা।
হাড় হিম করা শীতে পিঠা খাওয়ার ধুম পরে যায় বাড়িতে বাড়িতে। নবান্নের নতুন চাল আর খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয় পুলি পিঠা, নকশি পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা আরো হরেক রকমের পিঠা। নাড়ু, মুড়ি, খৈ, মুয়াও বানানো হয়। সন্ধ্যা হলেই বাজারে পিঠার দোকান বসে। গরম ভাপ উড়া শীতের পিঠা খেতে ভিড় জমায় মানুষ।
বিকেল হলেই পাখিরা আকাশে উড়ে উড়ে শীতল বাতাস গায়ে মাখে। হিমালয়ের পাদদেশে অতিথি পাখিরা নিমন্ত্রণ পেয়ে গেছে শীতের। শীতে তারা অতিথি হয়ে আসে আমাদের দেশে। তাদের সাথে আরো নাম না জানা পাখিদের আগমনে অপরুপ সৌন্দর্য ধারণ করবে প্রকৃতি। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হবে চারপাশ।
রাস্তার পাশে আগুন জ্বেলে আগুন পোহাবে ছোট থেকে বড় সবাই। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে পাবে উষ্ণতা। লেপ মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা শীতকালের সবচেয়ে আরামদায়ক কাজ। একবার লেপের ভেতর ঢুকে গেলে আর উঠতেই মন চায় না বিছানা ছেড়ে। সারাদিন শুয়ে থাকতেই আরাম লাগে।
তবে ছিন্নমূল মানুষের কাছে শীত আসে ভয়ংকর রূপে। বাসস্থান আর গরম কাপড়ের অভাবে শীতে কাঁপতে হয় তাদের। শীতকাল তাদের কাছে বাকী সবার মতো আনন্দের হয়না। প্রতিবছর অনেক মানুষ তীব্র শীতের কারণে মারা যায়।
গাছ থেকে ঝড়ে পরে যায় সব পাতা। শীতল বাতাসে উড়তে থাকে ঝড়ে যাওয়া পাতা। শুকিয়ে যাবে খাল-বিলের পানি। প্রকৃতি শীতকে বরণ করে নিচ্ছে। এ শহরের অলিতে-গলিতে শীত নিয়ে আসবে উৎসবের আমেজ। তাই সুপর্ণার হয়ে কবি ভাস্কর চক্রবর্তীকে বলাই যায়, ‘শীতকাল আসছে’।