জাল দিয়ে মাছ ধরা হবে-এমনটাই প্রথা। কিন্তু সেই জাল হতে হবে নির্দিষ্ট নিয়মের। জালের মধ্যে কিছু অংশ ফাঁকা রাখতেই হবে, যেন জাটকাসহ বিভিন্ন মাছের পোনা পরের মৌসুমের জন্য নদীনালা, খালবিল ও সমুদ্রে থেকে যায়। এটাই আইন। কিন্ত কে শোনে কার কথা! নিষিদ্ধ কারেন্টসহ অবৈধ জালের ছড়াছড়ি। গত অর্থবছরে প্রায় ২০০ কোটি মিটার অবৈধ জাল জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু জব্দের পরিমাণ খুবই সামান্য-পাঁচ থেকে দশ শতাংশ।
অবৈধ জাল ব্যবহারকারীদের প্রায় ৯০ শতাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন। নিষিদ্ধ জাল বন্ধ হলে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণে পৌঁছাত। সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ত দেশীয় অন্য মাছের সংখ্যাও। কিন্তু কারেন্ট ও নিষিদ্ধ জালের ফাঁদে ইলিশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উধাও হচ্ছে দেশীয় সব ধরনের মাছ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, নিষিদ্ধ জাল পুরোপরি বন্ধ হলে অভিযানেরই প্রয়োজন হতো না। ইলিশ উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি বিলুপ্ত হতো না দেশি মাছও। সরকার জেলেদের স্বাবলম্বী করাসহ বিনামূল্যে চালসহ খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছে। নিষিদ্ধ জাল পুরোপুরি বন্ধ হলে জেলে ও সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। এজন্য সাধারণ মানুষকে সোচ্চার হতে হবে। নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন, সরবরাহ, সে জাল দিয়ে মাছ শিকারে বাধা দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিষিদ্ধ জাল কী করে উৎপাদন থেকে পানি পর্যন্ত যায়, এ বিষয়ে প্রতিরোধকারী সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এজন্য জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হব। জেলেসহ সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। গবেষণায় উঠে এসেছে-একটি চিংড়ির ডিম ধরতে অর্ধশতাধিক ইলিশের ডিম নষ্ট হয়। সঙ্গে প্রায় তিমির মতো অন্যান্য মাছের ডিমও নষ্ট হচ্ছে। অবৈধ জালের ফাঁদে দেশি প্রজাতির রুই, কাতলা, মৃগেল, পুঁটি, শিং, মাগুর, কই, ট্যাংরা- প্রায় হারিয়ে গেছে।
নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, অবৈধ জাল দেশীয় মাছের বংশও বিনাশ করছে। অথচ মাছের চাহিদা দিনদিন বেড়েই চলেছে। চাষের মাছ উৎপাদন বাড়লেও স্বাদ-গন্ধে প্রশ্ন বাড়ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, কারেন্ট জাল তৈরি, ব্যবহার বন্ধ করা একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। কারেন্ট জালকে-কিছুতেই জাল বলা যায় না। এটি শুধু ঝাটকা নয়, সব মাছেরই সরাসরি মরণফাঁদ। এ জালের কাঁচামাল বিদেশ থেকে পাউডার হিসাবে আনা হয়।
এরপর সেই পাউডার গলিয়ে জাল তৈরি করা হয়। শূন্যে মিশে থাকা জাল চোখেও খুব একটা পড়ে না। আর পানি ফেলা অবস্থায় থাকলে যতক্ষণ না হাতে লাগে, ততক্ষণ বোঝার কোনো উপায় থাকে না, পানিতে জাল পুঁতা আছে কি না। এ জালের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে কাপড় ও মশারি জাল। এটি আরও ভয়ানক। ছোট মাছ থেকে বড় মাছের ডিম, এ দুই জালে কোনো কিছু বাদ যায় না। এসব জালের আগ্রাসনে খালবিল, নদীনালায় থাকা দেশীয় মাছ বিলুপ্তপ্রায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকঢোল বাজিয়ে অভিযানে যে পরিমাণ নিষিদ্ধ জাল জব্দসহ জেলেদের আটক করা হয়, তা খুবই সামান্য। নিষিদ্ধ জাল যেখানে তৈরি হচ্ছে, সেখানে বন্ধ করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে নৌপুলিশ কিংবা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ছাড়াও জেলা পুলিশ এবং জেলা-উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। গোয়েন্দা নজরদারিতে রেখে অবৈধ জাল তৈরিকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এতে নদীতে নিষিদ্ধ জাল যাবে না, লোক দেখানো অভিযানেরও প্রয়োজন হবে না। সর্বনাশা মশারি জাল বা কাপড় জাল উৎপাদনও বন্ধ করতে হবে কঠোরভাবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মৎস্য কর্মকর্তা থাকলেও নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন বন্ধ এবং সেই জাল দিয়ে মাছ ধরা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। শুধু জাটকা ধরা অবস্থায় জাল ও জেলেদের আটক করতে অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। এছাড়া কারেন্ট ও মশারি জাল দিয়ে বিভিন্ন জলাশয়ে অবৈধভাবে মাছ ধরা হচ্ছে, তা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। দেশীয় মাছের পোনা, ডিম পুরোপুরিই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নিষিদ্ধ জালের ফাঁদে।
মৎস্য অধিদপ্তর ইলিশ শাখা সূত্রে জানা যায়, কারেন্ট ও নিষিদ্ধ জাল জব্দেও জাটকা ধরা বন্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ লোকবল স্বল্পতায় সব অবৈধ জাল জব্দ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া জেলে পাঠালে জামিনে কিংবা সাজা খেটে এসে জেলেরা আবার নিষিদ্ধ জালে মাছ ধরতে শুরু করেন। একশ্রেণির দাদন ব্যবসায়ীরা আটক জেলেদের ছাড়িয়ে আনছেন। তারা অভিযানের খোঁজখবর রাখেন। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তরের কিছু অসাধু ব্যক্তি অভিযানের আগে নির্দিষ্ট দাদন ব্যবসায়ী ও জেলেদের ফোন করে জানিয়ে দেন।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার হাট থেকে সেপ্টেম্বরে ৫ লাখ মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০০ কোটি মিটার জাল জব্দ করা হয়। প্রায় ২ যুগ আগে ২০০২ সালে সংশোধিত মৎস্য সংরক্ষণ আইনে কারেন্ট জাল উৎপাদন, পরিবহণ, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সে আইন মানা হচ্ছে না।
চলতি বছর ৩০ মার্চ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, দেশে জাটকা রক্ষায় নানান কর্মসূচি নেওয়া হলেও জাটকা নিধন চলছেই। দেশের প্রায় ৬ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ ইলিশ পরিবহণ, বিক্রয়, জাল-নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত। তবে জাটকা নিধন প্রতিরোধ করা গেলে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম প্রতিকূলতা কারেন্ট জাল। বেহুন্দি জালসহ অন্যান্য অবৈধ জাল দিয়ে নির্বিচারে জাটকা নিধন হয়। এর বিরুদ্ধে সামাজিকভাবেও সবাইকে সোচ্চার হতে আহবান জানান তিনি।
নৌপুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজি শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নৌপুলিশ প্রতিনিয়তই অভিযান পরিচালনা করছে। কোটি কোটি টাকার কারেন্ট জাল ও সব ধরনের নিষিদ্ধ জাল জব্দসহ অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে। ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন ও ব্যবহার নির্মূল করতে নৌপুলিশ সতর্কাবস্থায় আছে। অনেক সময় অভিযানের খোঁজ পেয়ে অপরাধীরা আত্মগোপনে চলে যায়। এদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
এদিকে ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মা ইলিশ রক্ষায় সারা দেশে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ সময়ে সরকার জেলেদের ২০ কেজি করে চাল দিচ্ছে।