যতই দিন গড়াচ্ছে ততই ভয়ংকর হয়ে উঠছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। টেকনাফের গহিন অরণ্যের পাহাড়-জঙ্গলে আস্তানা গড়ে বাংলাদেশিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে রোহিঙ্গাদের অপহরণ সংগঠনের সদস্যরা। ক্যাম্পগুলোতে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গোলাগুলি অনেকটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সাঁড়াশি অভিযান চালালেই সন্ত্রাসীরা আশ্রয়শিবির থেকে বিতাড়িত হয়ে পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নেয়। যার কারণে ক্রমেই অনিরাপদ অঞ্চল হয়ে উঠেছে উখিয়া-টেকনাফ। অর্থের জোগান পেতে সন্ত্রাসীরা স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। তাতে টেকনাফের ৩টি ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের অন্তত ৭০ হাজার মানুষ ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সূত্রমতে, কক্সবাজারের সীমান্ত জনপদ টেকনাফে গত ৬ মাসে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে অন্তত ৬২ জনকে।
থানা সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ১ নভেম্বর থেকে এ বছরের ৩০ মে পর্যন্ত সাত মাসে টেকনাফ থানায় অপহরণের মামলা হয়েছে আটটি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা অন্তত ৫০। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ জনকে। একই সময়ে অপহৃত অনেককে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাবে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আড়াই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মানবপাচার ও পুলিশের ওপর হামলার মতো অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ খবর মতে, গত ৪ জুন অপহরণের শিকার হয়েছে হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা এলাকার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ হোসাইন সূর্য। তার পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। ঐ ছাত্রের বাবা সোলতান জানান, দুর্বৃত্তরা ফোন করে বলছে, ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে আমার ছেলেকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছি।
এর আগে গত ২ জুন লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পাঁচ রোহিঙ্গা যুবককে অপহরণ করে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ না দেয়ায় পরের দিন শনিবার রাতে এক যুবকের হাতের কবজি কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। পরে ওই হাতসহ তাকে ফেরত পাঠায় অভিভাবকের কাছে। মুক্তিপণ না দিলে বাকিদের হত্যা করা হবে বলে পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়েছে অপহরণকারীরা।
এই খবরে বাংলাদেশের শিশুরা এখন মাঠে খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিরাও রাত হলে ভয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান।
অপহরণের পাশাপাশি ‘অপহরণ সংগঠন’ গুলো চালিয়ে যাচ্ছে অস্ত্র ও মাদকের রমরমা বাণিজ্য। বাধা দিতে গেলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও গুলি চালাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তারা। নিয়মিত অভিযানে আটক করেও ঠেকানো যাচ্ছে না অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের। হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, স্বর্ণের চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় ‘অপরাধ রাজ্য’ তৈরি করেছে তারা। মাদকের পাশাপাশি মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, হত্যা, স্বর্ণের চোরাচালান বাড়ছে।
স্থানীয়রা জানান, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সদর ইউনিয়নের পাহাড়ে আস্তানা গেড়েছে ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তাদের অপহরণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু, ছেলেমেয়ে, স্কুলছাত্র; এমনকি অটোরিকশাচালকরাও। যে কোনো সময় যে কেউ অপহরণের শিকার হচ্ছে। ফলে স্থানীয় সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে সন্ধ্যার পর সন্তানদের ঘরের বাইরে যেতে দেন না। কেউ কেউ বিশেষ পাহারায় সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন।
অপহরণের ঘটনায় থানায় জিডি ও অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। গত ২৮ এপ্রিল পাত্রী দেখতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডী উত্তরপাড়ার মোহাম্মদ আলমের ছেলে জমির হোসেন রুবেল, তার দুই বন্ধু ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ সওদাগরপাড়া এলাকার মোহাম্মদ ইউসুফ ও কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকার ইমরান। ২৪ মে টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যারা এখন পুলিশের রিমান্ডে রয়েছে।
এ বিষয়ে হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাদিমোরা, লেদা, আলীখালী, রঙ্গীখালী, পানখালী, কম্মুনিয়াপাড়া ও মরিচ্চ্যঘোনা এলাকার মানুষ অপহরণ আতঙ্কে ভুগছে। এসব এলাকায় মাদক ব্যবসাও বেড়েছে। অপহরণকারীদের হাত থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুছাত্র পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না।’
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, আমার ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যম এলাকায় অন্তত ৭০০ পরিবার অপহরণ আতঙ্কে ভুগছে। এসব গ্রামের চারজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে।’
৮ এপিবিএন গত এক বছরে টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়-জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আমেরিকার তৈরি একটি এম-১৬ রাইফেলসহ ২৩৫টি অস্ত্র, ৫৩৪টি গুলি, ৯১ ভরি সোনাসহ ১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছিল। ড্রোন উড়িয়ে পাহাড়ে খনন করা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পরিখার সন্ধান পেয়ে সেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (ইন্টেলিজেন্স ও মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ জানান, গত দুই মাসে উখিয়ায় ৬/৭টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি অপহরণের পেছনে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক পাচারের বিষয়টি জড়িত। প্রত্যেক অপহৃতকে এপিবিএন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এপিবিএন সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা টাকার লোভে অপহরণ করছে। অপহরণের ঘটনা মাদকের লেনদেনের পেছনেও হচ্ছে। তাদের অনেকের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।