পৃথিবীতে একক প্রাণী হিসেবে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ক্ষুদ্র প্রাণী মশা। এই প্রাণীটির বিস্তার রোধে নানা উদ্যোগ নিলেও তাতে সফলতা আসেনি। বরং একঘেয়েভাব নানা কীটনাশক ও পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাণীটিকে আরও শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে। ফলে স্প্রে, কয়েল কিংবা অন্যান্য কীটনাশকেও মরছে না মশা। সামনে এটি আরও ভোগাতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
দেশের মশার জীবনচক্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা ট্রিবিউনের।
এতে তিনি মশা নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরেন। তার মতে, মশার হাত থেকে বাঁচতে মশা মারা নয় বরং মশা যাতে না জন্মাতে পারে সেটি নিশ্চিত করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এই গবেষক জানান, পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশার রেকর্ড আছে। পৃথিবীতে ২০০ প্রজাতির মশা মানুষের শরীরে রোগ ছড়ায়। আর বাংলাদেশে ১০-১২ প্রজাতির মশা মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়। এরমধ্যে ঢাকা ও এর আশপাশেই আছে ১৪টি প্রজাতি।
অঞ্চল ও জাতভেদে মশার আচরণ আলাদা মন্তব্য করে এই গবেষক জানান, শিল্পাঞ্চলে যেমন মশা আছে তার সঙ্গে গ্রামীণ অঞ্চলের মশার মিল নেই। আবার বান্দরবান, রাঙামাটিতে দেখা মেলে অন্য ধরনের মশার। প্রায় সব জাতের মশার মধ্যেই চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। একেকটির বহনকরা জীবানুর ক্ষমতাও একেকরকম। তবে বাংলাদেশে ডেঙ্গু মশার বিস্তার বেশি। এই মশায় প্রাণহানির পরিমাণও বেশি।
তিনি বলেন, “মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া রোগগুলো সাধারণত বাংলাদেশে হয়। পৃথিবীতে মশা-ই একমাত্র প্রাণী যে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মানুষ। তাহলে মশা ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও পৃথিবীতে প্রাণ হরণকারী হিসেবে সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে। এই মশাকে শাসন করা অনেক সময় কঠিন হয়। তবে একেবারে যে শাসন করা যায় না, ব্যাপারটা সেরকম নয়।”
মশার আক্রমণ থেকে বাঁচতে মশা মারার চেয়েও মশার জন্ম রোধ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান এই গবেষক। তিনি বলেন, “মশা নিয়ন্ত্রণের চারটি অস্ত্রের মধ্যে তিন নাম্বার অস্ত্র হলো কিটনাশক। আমাদের দেশে উড়ন্ত মশা মারার জন্য এখন ম্যালাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। মশার লার্ভা মারার জন্য টেমিফস ও নোভা লিউরন ব্যবহার করা হয়। এখন এই কীটনাশক যখন একটা জায়গায় দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয়, তখন ওই কীটনাশকের বিপরীতে মশা একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাটা কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মেয় স্থানান্তর হয়। এই স্থানান্তর ম্যাকানিজমটা পরীক্ষা করতে হয়। কারণ ওই কীটনাশকে আর প্রাণীটির কিছুই হয় না। অন্যথায় কয়েক বছর পর পর কিটনাশক পরিবর্তন করতে হয়।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে মশার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘদিন যাবত মশা রোধে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ মশাই সেসব কীটনাশকগুলোকে গ্রহণ করতে পারে। বড়জোর একটু গতিরোধ হয়। তবে কিছুক্ষণ পর মশাটি আবার সুস্থ হয়ে যায়। মশা পুরোপুরি নিধন হয় না। ফলে এসব কীটনাশক আর মশা মারতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। বরং মশার মধ্যে যে সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে সেটিই তাদের ডিএনএ ও জিনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মশার মধ্যে ছড়াচ্ছে। ফলে মশা আরও শক্তিসম্পন্ন হচ্ছে।”
বাংলাদেশে মশার উপদ্রব বৃদ্ধির ইতিহাস তুলে ধরে কবিরুল বাশার বলেন, “২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ এ বছরের মতো এত বেশি ছিল না। কোনো বছর আগস্টে, কোনো বছর সেপ্টেম্বরে বেশি হতো। এ বছর অস্বাভাবিক একটি পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। এর কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের কাল পরিবর্তন হয়েছে। এখন অক্টোবরেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। যে কারণে এডিস মশার প্রজনন অক্টোবরেও যথেষ্ট পরিমাণে হচ্ছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, যখন ডেঙ্গুরোগী বাড়তে থাকে, তখন এডিস মশাও বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে যদি দুটি জিনিস বাড়ে, তার যে কোনো একটাকে কমিয়ে দিতে হয়। কমিয়ে দিলেই সংক্রমণকে ধীরগতির করা যায়। আমরা কোনোটাই কমাতে পারছি না।”
ঢাকার মশার বিষয়ে তিনি বলেন, “ঢাকা শহরে এডিস মশার দুইটি প্রজাতি রয়েছে। একটি এডিস ইজিপ্টিআই এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিআই যে মশাটি, সেটি ডেঙ্গু রোগের প্রধান বাহক। মানুষের শরীরে ৯৫% ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী এ মশাটি। এ প্রজাতির মশাটিকে নগরের বা গৃহপালিত মশা বলা হয়। যেখানে অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়, সেখানে এ মশাটা বেড়ে যায়। ”
অধ্যাপক কবিরুল বাশারের মতে, রোগটি যেহেতু মশার মাধ্যমে ছড়ায় তাহলে মশা নিয়ন্ত্রণ করাই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কয়েকটি পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর মধ্যে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা, যেটিকে ইংরেজিতে ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট বলা হয়। এর চারটি কম্পোন্যান্ট আছে। প্রথমত, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা। দ্বিতীয়ত, বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল। অন্য জীব দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা। তৃতীয়ত, ক্যামিকেল কন্ট্রোল বা কীটনাশক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা। চতুর্থ হলো, জনসচেতনতা। চারটি কম্পোন্যান্টকে যখন আমরা একত্রিত করে সারা বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারব, তখন মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।
তিনি বলেন, “মশা প্রতিরোধে প্রয়োজন সমন্বিত ব্যবস্থা। যেটি সমন্বিতভাবে ব্যক্তি পর্যায় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে পারবে। ব্যক্তি পর্যায়ে মশার বংশরোধ করতে বংশবিস্তারের জায়গা তৈরি হতে দেওয়া যাবে না। আবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেটি মনিটরিং ও নিজেরাও কাজ করতে হবে। এজন্য আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন এই গবেষক।”