আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে পুঁজিবাজারে লেনদেনের ওপর ক্যাপিটাল গেইনের (মূলধনি মুনাফা) ওপর কর বসানো হয়েছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি এবং আর্থিক সংকটে থাকা বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিবেচনা করে মূলধন আয়ের উপর থেকে করারোপের প্রস্তাব প্রত্যাহারসহ সাত দফা সুপারিশ করেছে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)।
মঙ্গলবার (১১ জুন) মতিঝিলে ডিএসইর ব্রোকার্স ক্লাবে আয়োজিত বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সুপারিশগুলো করেন ডিবিএ প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম।
প্রস্তাবিত বাজেটের উপর ডিবিএর মতামত হচ্ছে: মূলধনী আয়কে করমুক্তকরণ, ব্রোকারেজের জন্য করহার যৌক্তিককরণ, মূলধন ক্ষতির উপর বিদ্যমান আইনের ব্যাখ্যা স্পষ্টীকরণ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ তালিকাভুক্তির রোডম্যাপ, অতালিকাভুক্ত সংস্থাগুলোর জন্য কর্পোরেট করের হার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত করের হারের বাহিরে বৃদ্ধিকরণ, নতুন বিও আইডিগুলোকে ৩ বছরের জন্য করমুক্ত রেখে পরিচালনা করার অনুমতি প্রদান এবং মার্জিন লসকে কর ছাড়যোগ্য হিসেবে অনুমতি দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবিএ প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূলধন আয়ের ৫০ লাখ টাকার অধিক আয়ের উপর স্তরভিত্তিক করারোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে, কোন সিকিউরিটিজ বিনিয়োগের সময়কাল ৫ বছর অতিক্রম করলে উক্ত বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয়ের উপর ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত কয়েকবছর ধরে মন্দাবাজার পরিস্থিতি এবং আর্থিক সংকটে থাকা বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিবেচনা করে মূলধন আয়ের উপর থেকে করারোপের প্রস্তাব রহিতকরণের জন্য আমরা জোর সুপারিশ করছি।
ব্রোকারেজের জন্য করহার যৌক্তিককরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে ব্রোকারেজ হাউজগুলো দুটি স্তরে কর প্রদান করে। প্রথমত- সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ০.০৫ শতাংশ এবং দ্বিতীয়ত করপোরেট আয়কর হিসেবে, যেটি বেশি হয় তা চূড়ান্ত কর হিসেবে গন্য করা হয়। এ দ্বিস্তরের ব্যবস্থার ফলে মন্দাবাজার পরিস্থিতিতে ব্রোকারদের ক্ষতি করে। কিছুক্ষেত্রে এই করের হার ৪০ শতাংশ বা তার বেশি ছাড়িয়ে যায়। ব্রোকাররা বাজারের অন্যতম অংশী। ব্রোকারদের আর্থিক সংকট ও অক্ষমতা বাজারের উন্নয়নকে চরমভাবে ব্যহত করে। তাই পুঁজিবাজারকে টিকিয়ে রাখতে এবং এর উন্নয়নে ব্রোকারদের সক্রিয় ও সচল রাখা দরকার। এ জন্য ব্রোকারেজ ব্যবসায়িদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ডিবিএ রাজস্ব করহার ০.০৫ শতাংশ থেকে ০.০২৫ শতাংশ হ্রাসকরণ এবং কর্পোরেট আয়করকে ব্রোকারেজের জন্য চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করার সুপারিশ করা হয়।
মূলধন ক্ষতির উপর বিদ্যমান আইনের ব্যাখ্যা স্পষ্টীকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডিবিএ বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটে মূলধন লাভের উপর করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ মূলধনী লোকসানের উপর ৬ বছর পর্যন্ত মূলধনী ক্ষতির জের বহন কিংবা সমন্বয় করার বিধান বিদ্যমান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিনিয়োগকারীর মূলধন ক্ষতির বিষয়ে থাকা বিদ্যমান আইনের সুস্পষ্ট ও কার্যকর ব্যাখ্যা প্রদানসহ এটিকে ৭ বছর পর্যন্ত প্রদেয় আয়করের বিপরীতে বহন বা সমন্বয় করার সুপারিশ করছি।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ তালিকাভুক্তির প্রসঙ্গে ডিবিএ প্রেসিডেন্ট বলেন, গত ১ দশকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। আমরা পুঁজিবাজারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোকে তালিকাভুক্ত করার জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করার অনুরোধ করছি। উক্ত বিষয়ে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ দেওয়া হলে বাজার মানসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজে প্রতিযোগীতামূলক ভালো ব্যবসা তৈরিতে উৎসাহিত হবে।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ তালিকাভুক্তির নির্দেশনা দিয়েছেন জানিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আশু বাস্তবায়নে সরকার ও বাজার সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করেন।
অতালিকাভূক্ত সংস্থাগুলির জন্য করপোরেট করের হার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত করের হারের বাহিরে বৃদ্ধিকরণ প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত করের হার ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু, অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট করের হার ব্যক্তিশ্রেনীর কর হারের নীচে। অন্যদিকে কর্পোরেটের ক্ষেত্রে তালিকাভূক্ত এবং অতালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে করের পার্থক্য ২.৫ শতাংশ এ নামিয়ে আনা হয়েছে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবদান, পুঁজিবাজারে প্রচার বিবেচনা করে ব্যক্তিগত এবং করপোরেট করের হারের মধ্যে পার্থক্য বিবেচনায় ডিবিএ ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশের উর্ধে অতালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট করহার নির্ধারন করা এবং নিয়মিত এবং সম্পূর্ন আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের শর্তে তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠানের করহার হ্রাসকরণের জন্য প্রস্তাব করেছে।
নতুন বিও আইডিগুলো ৩ বছরের জন্য করমুক্ত রেখে পরিচালনা করার অনুমতি প্রদান প্রসঙ্গে ডিবিএ জানায়, বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী সৃষ্টি তথা বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে বাজারের মূলধন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে আমাদের বাজারে এখন পর্যন্ত মোট জনসংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ সক্রিয় বিও একাউন্ট আছে, যেখানে ব্যাংকিং এবং এমএফএস কার্যক্রমে যথাক্রমে ২৮ শতাংশ এবং ৬৭ শতাংশ রয়েছে। যদি ব্যাংকিং এবং এমএফএস একাউন্টগুলিকে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগে নিয়ে আসা যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের জন্য মূলধনী লাভ, সুদ এবং লভ্যাংশ আয় তৈরি হবে। ফলে সরকারের যথেষ্ট পরিমান কর জেনারেট করা সম্ভব হবে। এমতাবস্থায় ডিবিএ বাজারের সম্প্রসারণের জন্য সব নতুন বিও একাউন্টগুলোকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগের সীমা সাপেক্ষে ৩ বছর পর্যন্ত সময়কালের জন্য কর বহির্ভূত রেখে পরিচালনা করার অনুমতি প্রদান করা এবং শিক্ষার্থী, সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি, প্রতিবন্ধীব্যক্তি এবং প্রবীণ নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত বিও হিসাবধারীদেরকে লাভের জন্য শূন্য হারে কর উপভোগ করার অনুমতি প্রদান করা ও এ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়।
সর্বশেষ মার্জিন লসকে কর ছাড়যোগ্য হিসেবে অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে ডিবিএ জানায়, মার্জিন লস বাজারের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়। দীর্ঘদিন ধরে থাকা এরুপ মার্জিন লসের কারনে অসংখ্য বিনিয়োগ একাউন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে যা তারল্য সংকটের মুখে গত কয়েকবছরে গুরুতর হয়ে উঠেছে।