যদি আপনি সবুজের রাজ্যে হারিয়ে যেতে চান, ইতিহাসের অলিগলি ছুঁয়ে দেখতে চান শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য, কিংবা পাহাড়ি প্রকৃতির নিঃশব্দ আহ্বান শুনতে চান—তাহলে আপনাকে যেতে হবে শেরপুরে। মেঘালয়ের কোলঘেঁষা এই সীমান্তবর্তী জেলা একাধারে জীবন্ত ইতিহাস, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির এক চমৎকার মিলনমেলা।
গারো পাহাড়: সবুজে মোড়া স্বপ্নপুরী
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত জুড়ে ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় প্রায় বিশ হাজার একর জুড়ে বিস্তৃত গারো পাহাড় প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক আদর্শ গন্তব্য। বর্ষায় সবুজের নতুন প্রাণ পায় পাহাড়গুলো; ঝরনায় নেমে আসে জলরাশির উচ্ছ্বাস, জঙ্গলে ঘন হয় লতাপাতার বাহার।
এখানে আছে শাল-সেগুনের বন, ছোট-বড় টিলা, রহস্যময় ঝরনা আর পাখির কলতান। ঝিরিঝিরি ঝর্ণার শব্দ, পাতার ফাঁকে রোদের ঝলকানি আর আকাশছোঁয়া পাহাড়ি দৃশ্য আপনাকে দেবে এক অপার্থিব আবেশ।
গজনী অবকাশ কেন্দ্র: বিনোদন ও প্রকৃতির মিলন
ঝিনাইগাতীর সীমান্তঘেঁষা কাংশা ইউনিয়নে অবস্থিত গজনী অবকাশ কেন্দ্র বহু বছর ধরে ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রয়েছে ঝুলন্ত ও ভাসমান সেতু, কৃত্রিম ঝরনা, নৌকা ভ্রমণের লেক, ওয়াটার কিংডম, ক্যাবল কার, শিশু পার্ক ও একটি মিনি চিড়িয়াখানা।
এটি একদিকে ছোটদের স্বপ্নপুরী, অন্যদিকে বড়দের জন্য শৈশবের ফিরে পাওয়ার জায়গা। অসংখ্য দোকানে হস্তশিল্প, খেলনা আর স্থানীয় খাবারও পাওয়া যায়। তবে সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় বিকেল পাঁচটার মধ্যে দর্শনার্থীদের কেন্দ্র ত্যাগ করতে হয়।
মধুটিলা ইকোপার্ক: জীববৈচিত্র্যের স্বর্গ
নালিতাবাড়ী উপজেলার শমশ্চূড়া বিটে ৪০ হেক্টর বনভূমির উপর গড়ে ওঠা মধুটিলা ইকোপার্ক শেরপুর জেলার অন্যতম আকর্ষণ। এখানকার ১০০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে দিগন্তজোড়া সবুজ আর সীমান্তপারের তুরা পাহাড়।
ঘন বৃক্ষরাজি, সরু বনপথ, বুনো পাখির ডাক আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাপন একসাথে মিলে গড়ে তোলে অপার সৌন্দর্য। মধুটিলা শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য নিদর্শন।
রাজার পাহাড়: প্রকৃতির মহিমাময় প্রতীক
শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে অবস্থিত রাজার পাহাড় গারো পাহাড়মালার গর্ব। এর সবুজ চূড়ার ওপরে সমতল ভূমি থেকে দূরের আকাশকে মনে হয় হাতছানি দেওয়া কোনো স্বপ্নপুরী।
ঘন জঙ্গল, সরু পথ আর বুনো পাখির ডাক এখানে ভ্রমণকারীদের নিয়ে যায় রূপকথার রাজ্যে। পাহাড়চূড়ার পথে বাবেলাকেনা কালচারাল একাডেমি দেখা যায়, যেখানে রয়েছে পাহাড়ি আদিবাসী সংস্কৃতির জাদুঘর, পাঠাগার ও মিলনায়তন। ফলে রাজার পাহাড় শুধু প্রকৃতি নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতিরও জীবন্ত প্রেক্ষাগৃহ।
ঘাগড়ালস্কর খানবাড়ী মসজিদ: মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন
ঝিনাইগাতীর ঘাগড়ালস্কর গ্রামে গারো পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে মুঘল আমলের খানবাড়ী মসজিদ। হিজরি ১০২৮ (ইংরেজি ১৬০৮) সালে নির্মিত এই মসজিদের দেয়ালে আজও দেখা যায় প্রাচীন কারুকাজ। গম্বুজঘেরা এই মসজিদের চারপাশে রয়েছে দশটি মিনার, যেন ইতিহাসের নীরব প্রহরী।
চুন-সুরকির গাঁথুনিতে তৈরি অনুপম স্থাপত্যশৈলী এখনো বিস্মিত করে ভ্রমণকারীদের। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ করেছে।
ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সহাবস্থান
শত শত বছরের পুরনো মাই সাহেবা মসজিদ, বারদুয়ারী মসজিদ, শহরের গোপীনাথ ও অন্নপূর্ণা মন্দির ধর্মীয় সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ সবকিছু মিলে শেরপুর কেবল একটি জেলা নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের এক সুন্দর সমন্বয়।