উন্নয়ন বলতে বোঝায় কোনো অগ্রগতি বা অগ্রসরমান ব্যবস্থা বা কোনো কিছু বৃদ্ধি অথবা ব্যাপকতার ফলস্বরূপ প্রাপ্তি। এককথায় বলা যায়, উন্নয়ন হচ্ছে এক অবস্থা বা স্তর থেকে উন্নত বা কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় উত্তরণ। তবে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মনে করেন, কোনো জাতি যদি কোনো সময়ের জন্য উন্নত জীবনযাপন করে, তবে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে না। উন্নয়নের গূঢ় অর্থ হলো ইতিবাচক উন্নত উন্নয়নের স্থায়িত্ব। যেমন কোনো দেশের সরকার যদি জনগণের মধ্যে পানির পাম্প বিতরণ করে, তাহলে যত দিন বিতরণ করবে, তত দিন তাদের পানির কোনো অভাব থাকবে না। যখন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, তখন আবার তাদের দূর অবস্থা ফিরে আসবে। সুতরাং এ ধরনের বিতরণ বা সরবরাহ কোনোভাবেই উন্নয়নের সূচক নয়। এজন্য তিনি অবস্থার স্থায়িত্বকে মুখ্য হিসেবে গণ্য করেছেন; যা জনগণের জীবনে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জীবনে চলার প্রতিটি স্তরে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের একদম সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন না হয় তাহলে সেটাকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলে গণ্য করা যাবে না।
বর্তমানে সরকারি–বেসরকারি নানা উদ্যোগে বাংলাদেশ সত্যিই বদলে যেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভালো করছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অকল্পনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রমাণ করে আমাদের দেশে এখন অনেক বড়লোক। যেমন গত কয়েক দিন আগে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘আকাশচুম্বী খরচ উন্নয়নে’। ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। তিন বছরের প্রকল্পের মেয়াদ এখন ১৪ বছর। পত্রিকার এই শিরোনাম প্রমাণ করে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। সরকার শুধু প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছে। তবে দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দক্ষ প্রশাসন ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ বিষয় গুলো নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে।
উন্নয়নের সুফল কতটুকু ভোগ করছে জনগণ-
এখন বাংলাদেশে উন্নয়নের বয়ান অহরহ প্রচারিত হচ্ছে। প্রশ্নটি হলো, উন্নয়নের জন্য ব্যয় এবং উন্নয়ন থেকে প্রাপ্ত সুফল কতটুকু সর্বসাধারণ ভোগ করতে পারছে, তার যৌক্তিক দিক পর্যালোচনা করা জরুরি। দেশ এখন বিশ্বের সেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, মাথাপিছু আয় এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভালো করছে ইত্যাদি কথা বলে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আরও দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। উন্নয়ন প্রকল্পের অকল্পনীয় অর্থ বরাদ্দেই প্রমাণ করে, বড়লোক দেশ, বড় বাজেট নিয়ে কাজ করছে সরকার।
এখন খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধি বাড়ার ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। কিন্তু দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দক্ষ প্রশাসন ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কোনো দেশ দুর্নীতি, অশান্তি লালন করে টেকসই উন্নয়ন আশা করতে পারে না। এটা সত্য, বৈশ্বিক অনেক সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়েছে। তবে পরিবেশদূষণ, যানজট, দুর্নীতি সমস্যার সমাধানে সরকার কাজ করলেও আমরা এগুলোতে বেশ পিছিয়েই আছি। দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তার ভিত্তি বা শিকড় যদি দৃঢ় না হয়, তবে একটা সময় তা ধসে পড়তে পারে। এ শঙ্কার কথা আবারও ব্যক্ত করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)। সম্প্রতি সিপিডির প্রতিবেদনে বলেছে, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সঠিক পথে নেই বাংলাদেশ। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণ করার মতো তথ্য-উপাত্ত পর্যন্ত নেই।
চার বছরে বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়ন মূল্যায়ন: বেসরকারি খাতের ভূমিকা। শীর্ষক প্রতিবেদনে সিপিডি বলেছে, বৈষম্য দূরীকরণ, শান্তি ও ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের এখনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। তবে সবার জন্য শিক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রাথমিকভাবে সাফল্য এসেছে। এসডিজি অর্জনে সফল হতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জবাবদিহি এবং সুশাসন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।