অবশেষে বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে সরকার পতনের ‘এক দফা’ চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র দল গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্য শরিকদের সঙ্গে আলোচনার পর স্ব স্ব অবস্থান থেকে এই ‘এক দফা’ ঘোষণা করা হবে। যাকে যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের ‘এক দফার যৌথ ঘোষণা’ বলে অভিহিত করা হবে।
একই সঙ্গে ‘এক দফার ভিত্তিতে আগামী জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সর্বাত্মক আন্দোলনের লাগাতার কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কী ধরনের কর্মসূচি হবে তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে তা ‘শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক’ হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
বিএনপি নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, মূলত এক দফা হিসেবে অভিহিত করা হলেও তাতে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাতে রয়েছে- এক. বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ, দুই. বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, তিন. নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা, চার. বিদ্যমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, পাঁচ. বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল, ছয়. সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
১৬ জুন ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির এই ‘এক দফা’ চূড়ান্ত হয়। এর আগে ১২ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এক দফার আন্দোলন নিয়ে আর দেরি না করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান। যদিও এক দফায় কয়টি ইস্যু থাকবে, তা সেদিন চূড়ান্ত হয়নি।
উল্লেখ্য, ‘এক দফার ইস্যুগুলো নিয়ে বিএনপির সঙ্গে শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকটি অমিল ছিল। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, মঞ্চের এক দফার খসড়ায় উল্লেখিত ‘খালেদা জিয়াসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি’র বিষয়টি। তবে দুই পক্ষের বৈঠকে এক পর্যায়ে এসব অমিলও কমে আসে।
বিএনপির চূড়ান্ত করা ‘এক দফা’ সম্পর্কে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক ও আলাপ-আলোচনার পর আমরা যে এক দফা চূড়ান্ত করেছি তা বিএনপিকে দিয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে তেমন একটা মতানৈক্য নেই।’
তিনি আরও জানান, ‘এক দফা’টি ‘যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের এক দফার যৌথ ঘোষণা’ হিসেবে অভিহিত হবে। এটি চূড়ান্ত হলে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর স্ব স্ব অবস্থান থেকে তা ঘোষণা করা হবে।
সাইফুল হক জানান, গণতন্ত্র মঞ্চ রাষ্ট্র সংস্কারের ‘যৌথ রূপরেখা’ ও ‘এক দফা’র যৌথ ঘোষণার সঙ্গে উপস্থাপন করার চিন্তা রয়েছে। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাদের তেমন কোনো মতানৈক্য নেই। কনটেন্টে (বিষয়বস্তু) কোথাও কোথাও অমিল থাকলেও ৩১ দফা ঠিক আছে। কনটেন্টেও ১২ আনাই মিল রয়েছে। তিনি বলেন, মোটা দাগে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ও ‘রেইনবো নেশন’- এ দুটি বিষয়ে অমিল রয়েছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে বিএনপির উদ্যোগে পরিচালিত যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলগুলোর একটি অভিন্ন দাবিনামা প্রণয়নের প্রস্তাব দেয় গণতন্ত্র মঞ্চ। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফা, এবং বিএনপির আন্দোলনের ১০ দফা ও রাষ্ট্রমেরামতের ২৭ দফার মধ্যে সমন্বয় করার জন্য একটি ড্রাফট কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি উভয়ের দফাগুলোকে সমন্বয় করে ৭ দফা প্রণয়ন করে, যেটি ‘অভিন্ন রূপরেখার যৌথ ঘোষণাপত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু অন্য শরিকদের আপত্তির মুখে বিএনপি তা থেকে পিছিয়ে আসে। এর পর গণতন্ত্র মঞ্চ ৩৫ দফা প্রণয়ন করে, তবে তা নিয়েও বিএনপির মধ্যে আপত্তি ওঠে। অবশেষে যুগপৎ আন্দোলনের সব শরিকের দাবিনামাকে সমন্বয় করে বিএনপি ৩১ দফার একটি যৌথ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করলে সেখানকার তিনটি ইস্যু নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ আপত্তি জানায়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্ষমতা ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার গঠন প্রক্রিয়া। এর পরই তা বাদ দিয়ে আন্দোলনের এক দফা প্রণয়নে মনোযোগ দেয় বিএনপি। এতে আপত্তি করেনি গণতন্ত্র মঞ্চ ও অন্য শরিকরা।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, এক দফা চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর এখন রাষ্ট্রমেরামতের যৌথ রূপরেখাও চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এটিও ঘোষণা করা হবে, কিন্তু দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। আন্দোলনের অভিন্ন এক দফা ঘোষণার আগেই এটি ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে অভিন্ন এক দফার যৌথ ঘোষণা দেওয়ার পর লাগাতার কর্মসূচি আনতে চাইছে বিএনপি। এক্ষেত্রে কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে তা শরিকদের সঙ্গে আলাপ করেই চূড়ান্ত করা হবে। তবে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে কিংবা সরকার পতনের জন্য ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচিও বৈঠকে আলোচিত হয়েছে।
বিএনপি বর্তমানে যুগপৎ ধারায় দলীয় কর্মসূচি পালন করে আসছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষিত হওয়ার পর বিএনপির হাইকমান্ড ধারণা করছে, এখন সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণায় আর দেরি নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতির মাঠ অনেকটাই বিএনপির অনুকূলে। এজন্য এটিকেই সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার ‘মোক্ষম সময়’ মনে করছে বিএনপি।
এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এখন আমাদের দাবি একটাই, এই সরকারের বিদায়। দেশে-বিদেশে বর্তমান অবৈধ সরকারের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। এজন্য দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে। তাই আমরা বলেছি, মানে মানে কেটে পড়ুন। না হলে তাদের বিদায় হবে খুবই করুণ।’