মেট্রোরেল বলতে বোঝায় শুধুমাত্র টাউন বা সিটির মধ্যেই যে সমস্ত ট্রেন যাতায়াত করে। আবার মেট্রো বলতে, অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত জনবহুলবড় শহর বুঝায়। (কোনো শহরে বসবাসকারী জনসংখ্যা তথা নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য-এর উপর নির্ভর করেই কোনো শহর কে মেট্রো শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।) আবার মেট্রো বলতে, ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও বুঝায়। কোনো কোনো দেশে একে টিউব বলা হয়।
আধুনিক বিশ্বায়নের অন্যতম একটি যাতায়াত ব্যবস্থা হচ্ছে মেট্রোরেল ব্যবস্থা। আমরা যেকোনো স্থানে যাতায়াতের জন্য অনেক সময় ব্যয় করে থাকি তার জন্য আমরা কম সময়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের আধুনিক প্রকল্প চালু করছি। সেই আধুনিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে মেট্রোরেল অন্যতম। বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়েছে বলে সকলের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। মেট্রোরেল তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকা শহরের এই অসহনীয় যানজট থেকে কিছুটা মুক্তি খোঁজ করা।
ঢাকার মেট্রোরেলে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। স্টেশনের নির্দিষ্ট পয়েন্টে, নির্দিষ্ট স্থানে স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে যাবে দরজা। এটি নিয়ন্ত্রণের সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নিপ্পন। এই রেল চালু হলে বছরে ১.৮ লক্ষ টন গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমবে বলে জানিয়েছে জাইকার প্রধান প্রতিনিধি ইউহো হায়াকাওয়া। এই ট্রেন ওজনে হালকা। প্রবেশ ও বাহিরের মুখে চিপ যুক্ত কার্ড থাকবে। কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে এই ট্রেন। রেলের একেকটা বগিতে ২৩০০ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। ভিতরে ২-৬ জন বসার মতো জায়গা থাকবে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রতিটি স্টেশনের আগে আসবে স্বয়ংক্রিয় ঘোষণা। ট্রেনের বাইরে ও ভিতরে থাকবে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা। মরিচা নিরোধ ইস্পাত দিয়ে তৈরি এই ট্রেন ওজনে অনেক হালকা। ট্রেনের গতি থাকবে ঘন্টায় ষাট কিলোমিটার পর্যন্ত। স্টেশনে যাত্রীদের তাৎক্ষনিক টিকেট কাটার ব্যবস্থার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ও মাসিক টিকেট কাটার ব্যবস্থাও থাকবে। যাকে বলা হচ্ছে রেপিড পাস। এই পাস প্রবেশের মুখে স্পর্শ করালে স্বয়ংক্রিয় ভাবে দরজা খুলে যাবে। এই প্রযুক্তিটা তৈরি করছে সনি কোম্পানি। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হয় এই ট্রেন। এর ব্যবস্থাপনা ব্যয় কম। এই রেল চলাচলের সময় এক সেকেন্ডও এদিক সেদিক হবে না। প্রতিটি স্টেশনে থাকবে সুপরিসর প্লার্টফর্ম, যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। পুরো স্টেশন থাকবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। স্টেশনের দ্বিতীয় তলা নগরবাসীর রাস্তা পারাপারে জন্য ব্যবহৃত হবে।
২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই প্রকল্পের উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে, যা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে, এমআরটি-৬ লাইনের প্রথম পর্যায়ের দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও অংশ ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ জনসাধারণের চলাচলের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন এবং তিনিই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম যাত্রাটি করেন।
জর্জ স্টিফেনসনের যুগান্তকারী প্রচেষ্টায় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বের প্রথম রেলওয়ে ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ২৬ কিমি দূরবর্তী ডার্লিংটন পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উদ্বোধন করা হয়।
মেট্রো রেলের আবিষ্কারক চার্লস পিয়ারসন। পৃথিবীর সর্বপ্রথম মেট্রো রেল চালু হয় ইউরোপের লন্ডনশহরের আন্ডার গ্রাউন্ডে 1863 সালের 10 – ই জানুয়ারি। এটি ছিল স্টিম ইঞ্জিনের। আর ১৮৯০ সালে এসে লন্ডন মেট্রোতে যুক্ত হয় ইলেকট্রিক রেল। এখন দেশটিতে প্রায় ৪০২ কিলোমিটার পথে মোট মেট্রোর ১১টি লাইনে ট্রেন চলে। প্রতিদিন চলে অন্তত ৫৪০ ট্রেন। ২৭০টি স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়।ইউরোপের আরেক দেশ হাঙ্গেরিতে মেট্রোরেলের সূচনা হয় ১৮৯৬ সালে। রাজধানী বুদাপেস্টের বাসিন্দারা ওই বছরের মে মাসে এই ট্রেনে ওঠে। মেট্রোরেল চালু হওয়া তৃতীয় দেশ স্কটল্যান্ড। ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে দেশটির গ্লাসগো শহরে এই ট্রেনের যাত্রা করে। ১৮৯৭ সালে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক বোস্টন সাবওয়ে চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। আর ১৯০৪ সালের অক্টোবরে নিউইয়র্কে চালু হয় মেট্রোরেল। দেশটির দ্বিতীয় ব্যস্ততম মেট্রোরেল চলে শিকাগো শহরে। ১৯০০ সালের ১৯ জুলাইয়ে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে চালু হয় মেট্রোরেল। ২০১৬ সালে প্যারিসে মেট্রোতে যাত্রী ছিল প্রায় ১.৫২ বিলিয়ন। জার্মানির বার্লিনে ‘ইউ-বাহন’ নামে এই নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু ১৯০২ সালে। ১৫১ কিলোমিটর দ্যৈর্ঘ পথে মোট ১০টি লাইনে চলে এই ট্রেন, যার প্রায় ৮০ শতাংশই পাতাল ট্রেন। এশিয়ায় প্রথম মেট্রো নেটওয়ার্ক চালু হয় জাপানে। দেশটির রাজধানী টোকিওতে ১৯২৭ সালে এই ট্রেনের যাত্রা। এরপর চীনের বেইজিং ও দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে চালু হয় মেট্রো। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় ১৯৮৪ সালে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ওই বছরের অক্টোবরে এই ট্রেনের যাত্রা করে। দেশটির রাজধানী দিল্লিতে এই ট্রেনে মানুষ ওঠে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে। এটি ভারতের অন্ততম ব্যস্ততম মেট্রো নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে মেট্রোরেল চালুর দুই বছর আগে পাকিস্তানে এর যাত্রা শুরু। ২০২০ সালের অক্টোবরে দেশটির লাহোর শহরে এই নেটওয়ার্ক চালু হয়। এরপর আর কোনো শহরে এখনো এই ট্রেন চালু হয়নি।