সরকার পতন আন্দোলনের রোডম্যাপ তৈরি করছে বিএনপি। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একদফার ভিত্তিতে যৌথ ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করার কথা ভাবছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জাতির সামনে কোনো বিকল্প নেই। একটাই লক্ষ্য, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকারকে বাধ্য করতে হবে একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। এর মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার যেন আমরা প্রতিফলন ঘটাতে পারি, পূরণ করতে পারি।’
তিনি বলেছেন, ‘আমরা মূলত একদফার আন্দোলনেই আছি। এটা একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে আসবে, যা খুব শিগগিরই দেখতে পারবেন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন কোরবানি ঈদের পর দ্রুত ঢাকায় ফিরতে। তিনি বলেন, ‘সবাই যদি ঢাকায় একসঙ্গে আসেন, আর বাংলাদেশের মানুষ যদি ঢাকার দিকে আসা শুরু করে, তাহলে কী হবে বোঝেন! যদি এটা বোঝেন, তার জন্য প্রস্তুত থাকেন।’
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির ব্যাপারে বোঝাপড়ায় আসতে চায় বিএনপি। এই মাস টার্গেট করেই আন্দোলনের রোডম্যাপ তৈরি করছে তারা। এর আগে জুলাইয়ের মাঝামাঝি একদফার ভিত্তিতে আন্দোলনের যৌথ ঘোষণা দিয়ে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি ও মিত্ররা। এই আন্দোলনে জনগণকে ব্যাপকভাবে মাঠে নামানোর পরিকল্পনাও নিয়েছে তারা।
দলটি বলছে, প্রাথমিকভাবে দাবি আদায়ে আগের কর্মসূচিগুলো আবারও দেওয়া হবে। এসব কর্মসূচিতে শোডাউন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক কোনো কর্মসূচিতে না-যাওয়ার চিন্তা রয়েছে দলটির। বিএনপি চায়, গতানুগতিক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা ঘটিয়ে একপর্যায়ে সরকারকে বড় ধাক্কা দিতে।
বিএনপি এখন চূড়ান্ত আন্দোলনের ওয়ার্মআপ হিসেবে তার তিন সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলকে দিয়ে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করাচ্ছে।
বিএনপি জানিয়েছে, এই সমাবেশগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ততা ঘটানো। এই সমাবেশগুলো ঘোষণার পর আওয়ামী যুবলীগও একই স্থানে একই সময়ে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। পরে বিএনপি তাদের কর্মসূচির সময়সূচি পুনর্নির্ধারণ করে। এরই মধ্যে তিনটি স্থান যথাক্রমে চট্টগ্রাম, বগুড়া ও বরিশালে তারুণ্যের সমাবেশ হয়েছে। ৯ জুলাই সিলেট, ১৭ জুলাই খুলনা ও ২২ জুলাই ঢাকায় এই সমাবেশ রয়েছে।
আগামী ২২ জুলাই ঢাকায় তারুণ্যের যে সমাবেশ রয়েছে তাতে ব্যাপক উপস্থিতির জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, তারুণ্যের সমাবেশ ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এখন পর্যন্ত তিনটি সমাবেশ হয়েছে। সেসব সমাবেশে তরুণদের ব্যাপক উপস্থিতি আমাদের আশান্বিত করেছে। সামনের সমাবেশগুলোতেও ব্যাপক উপস্থিতি আশা করছি। তিনি বলেন, ঢাকার সমাবেশ নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। আশা করছি এ সমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি ঘটবে।
ঈদের পরই বিএনপি সমর্থিত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সাবেক ও বর্তমান নারী জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। এরই মধ্যে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে তৃণমূলের এসব প্রতিনিধির একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে একদফার ভিত্তিতে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনকে বেগবান করা।
এবার বিএনপির চার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন কৃষক দল, শ্রমিক দল, তাঁতি দল ও মৎসজীবী দলের যৌথ উদ্যোগে ৬ বিভাগে পালন করা হবে পদযাত্রা। বিএনপি সিনিয়র যগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২৭ জুন এই পদযাত্রা কর্মসূচির সময়সূচি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, নোয়াখালী ১৫ জুলাই, দিনাজপুর ১৯ জুলাই, রাজশাহী ২৮ জুলাই, যশোর ৫ আগস্ট, হবিগঞ্জ ১২ আগস্ট ও বরিশালে ১৯ আগস্ট হবে।
চলমান আন্দোলনে বিগত দিনের মতো ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে বাধা সৃষ্টি করা হতে পারে আশঙ্কা করছে বিএনপি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন ভিসানীতির আলোকে পদক্ষেপও নিচ্ছে দলটি। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা, হামলা ও নেতাকর্মীদের নির্যাতনের ঘটনা এবং জড়িত পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের তালিকা করতে গত ৩ জুন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি তথ্য সংগ্রহ কমিটি গঠন করে বিএনপি। এরই মধ্যে এই কমিটি বেশ কয়েকটি ঘটনায় ৩৩ পুলিশ সদস্য এবং ১০ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে দায়ী করে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে। রুহুল কবির রিজভী বলেন, প্রতিটি ঘটনার প্রমাণ হিসেবে ভিডিও, ছবি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংযুক্ত করা হয়েছে।
দূতাবাসগুলোতে দেওয়া বিএনপির ওই চিঠিতে বলা হয়, সমাবেশে যেতে বাধা দেওয়ার এ ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। কারণ এতে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে বড় হুমকি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অন্য দেশগুলো জানতে চাইলে আমরা তাদের জানাই। এটা তারই অংশ।
সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফার ভিত্তিতে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও তার মিত্ররা। ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত যুগপৎভাবে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। ওই সময় পর্যন্ত গণমিছিল, গণঅবস্থান, মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে ঈদুল ফিতরের পর থেকে বিএনপি ও তার মিত্ররা এককভাবে কর্মসূচি করছে। তারা এসব কর্মসূচিকে যুগপৎ ধারায় দলীয় কর্মসূচি বলছে। একদফার ভিত্তিতে যৌথ ঘোষণা দেওয়ার পরই শুরু হবে যুগপৎ আন্দোলন।
গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষিত হওয়ার পর বিএনপিসহ বিরোধী দল তাদের কর্মসূচি পালনে আগের মতো সরকারি বাধার সম্মুখীন হচ্ছে না। বিএনপির এক সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াত ১০ বছর পর গত ১০ জুন ঢাকায় সমাবেশ করে। তারা মগবাজারের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে বন্ধ দলীয় কার্যালয় খোলার সিদ্ধান্তও নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে মগবাজারের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চলছে সংস্কারকাজ।
বরিশাল সিটি নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের ওপর হামলার কারণে বর্তমান সরকারের অধীনে সব নির্বাচন বর্জন করেছে সরকারের প্রতি নমনীয় দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিএনপি মনে করে, এটা তাদের এক ধরনের বিজয়। এখন যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের বাইরে অন্য যেসব দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায় না, তাদের আন্দোলনের এক সুতায় কীভাবে বাঁধা যায়, সেই কৌশল নিচ্ছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু বলেন, ‘ইসলামী আন্দোলন ঘোষণা দিয়েছে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, এই সরকারের পতন ছাড়া ঘরে ফিরবে না।’