কোনো কাজের চাপ ছাড়াই পুরো একটা দিন, নিজেকে ভীষণ ব্যস্ত প্রমাণ করা নিরস মানুষটিও ভেতরে ভেতরে পোষণ করেন এমন ইউটোপিয়া। কাজের মাঝেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া মনটিও এক সময় খেই হারিয়ে ফেলে। তখনই প্রয়োজন হয় ছকে বাধা বন্দিশালা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। পাশেই কোনো নদী বয়ে নিয়ে যাবে মনের সকল অস্থিরতা।
ঠিক এই অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যই যেন গড়ে উঠেছে ঢাকার পূর্বাচলের মনোরম রিসোর্টগুলো। চলুন, রিসোর্টগুলো সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিই।
লা রিভেরিয়া রিসোর্ট
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাঠের তৈরি কটেজ, ১০০-এরও বেশি কার পার্কিং, বিস্তৃত খেলার মাঠ এবং সুইমিং পুলের বিশাল রিসোর্ট লা রিভেরিয়া। পূর্বাচল ৩০০ ফিটের শেষ প্রান্তে কাঞ্চন ব্রিজ পেরিয়ে মাত্র ১০ মিনিট দূরত্বেই এর অবস্থান। ২০১৯ সালে শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে গড়ে ওঠা এই স্থাপনায় পাওয়া যাবে ৩৬০ ডিগ্রি রিভারভিউ।
সবুজের ঘেরা মাঠ, বার্বিকিউ আর মঞ্চ বানানোর ব্যবস্থা থাকায় যে কোনো অনুষ্ঠানের জন্যই উপযুক্ত লা রিভেরিয়া। তবে উদ্যানসম এই রিসোর্ট ঘুরে দেখতে হলে দিতে হবে ২৫০ টাকা প্রবেশ মূল্য। দিনব্যাপী প্যাকেজগুলো শুরু হয় ১,৫০০ টাকা থেকে। কটেজে থাকতে গেলে খরচ করতে হবে ৩,৫৫০ টাকা। রাত্রিযাপনে তা বেড়ে হবে ৫,৭৫০ টাকা।
ছুটি রিসোর্ট
স্যুট, কুটির, ভিলা, রেস্টুরেন্ট, পুল ক্যাফে, কনভেনশন হল, সুইমিং পুল, জাকুজি, বিউটি শপ, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, এবং তাঁবু খাটানোর জায়গা মিলে বেশ বিলাসবহুলই বলা চলে ছুটি রিসোর্টকে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সজ্জিত ২২টি স্যুট এবং কটেজে মোট ৬০ জন অতিথি থাকতে পারেন।
ছুটি রিসোর্টের সেরা অংশটি হচ্ছে এর খোলা উঠানটি। লাইভ মিউজিক, ডিজে, খেলাধূলাসহ মত নানা ধরনের ইভেন্টের জন্য এটি উপযুক্ত। এছাড়া ইনডোর কার্যক্রমের জন্য কনভেনশন হল তো আছেই।
এই জাঁকজমক সুবিধাসহ দিনব্যাপী খাবার-দাবারের প্যাকেজগুলো শুরু হয় ৮,২২২ টাকা থেকে, যার সর্বোচ্চ প্যাকেজ মূল্য ২০,২৪০ টাকা।
চেক-ইন সময় দুপুর ১টা এবং চেক-আউট সময় দুপুর ১২টা। সাড়ে ১২টার পরে চেক আউটের জন্য ৫০% রুম চার্জ ধার্য হয়।
রিসোর্টটি ঘুরতে হলে যেতে হবে পূর্বাচল নতুন শহরের কাছাকাছি রাথুরা নামক জায়গার নাগোরিতে। এটি কুড়িল বিশ্বরোড থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে। কুড়িল থেকে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যেতে হবে কাঞ্চন ব্রিজের দিকে। ব্রিজ পার হওয়ার আগে বামে এশিয়ান হাইওয়ের দিকে মোড় নিতে হবে। অতঃপর এই পথ ধরে যেতে হবে গোলান বাজার পর্যন্ত। বাজার থেকে এই রিসোর্ট মাত্র ৫ মিনিটের রাস্তা।
সপ্তর্ষি রিভারসাইড রিসোর্ট
শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী সপ্তর্ষি রিসোর্টের বিশেষত্ব হলো এর ট্রি-হাউস। গাছের বাড়িতে বসে অনায়াসেই সামনে বহতা নদীর মন ভোলানো দৃশ্য অবলোকন করা যায়। আর এটিই যথেষ্ট কাঠের কুটির, প্রশস্ত খোলা জায়গাসহ রিসোর্টের বাকি সুবিধাগুলোকে এক নিমেষে ভুলে যেতে।
এখানকার দিনব্যাপী প্যাকেজ উপভোগ করতে হলে ন্যূনতম ৪ জনের গ্রুপ নিয়ে আসতে হবে। প্যাকেজ মূল্য শুরু হয় ৬,২০০ টাকা থেকে এবং সর্বোচ্চ প্যাকেজ মূল্য ৯,০০০ টাকা। প্যাকেজে সকালের নাস্তা, দেশি-বিদেশি খাবারসহ দুপুরের খাবার, এবং সন্ধ্যার হাল্কা নাস্তা থাকে। মূল্য কমবেশি হয় খাবারের মেনু এবং থাকার রুমের ধরনভেদে।
পূর্বাচলের কাঞ্চন ব্রিজ থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত সপ্তর্ষি রিভারসাইড রিসোর্ট।
পূর্বাচল শীতলক্ষ্যা রিসোর্ট অ্যান্ড পার্ক
চমৎকার এই রিসোর্টের অবস্থান সপ্তর্ষি রিভারসাইড রিসোর্টের মাত্র ৩০০ মিটার পরেই। কাঞ্চন ব্রিজ থেকে আধা কিলোমিটার দূরের এই জায়গার নাম পিতলগঞ্জ মসজিদ ঘাট, যেটি মুলত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পড়েছে।
মোট ২৫০ কাঠা জমির ওপর গড়ে ওঠা এই রিসোর্টে প্রশস্ত জায়গা নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে কাঠের কুটিরগুলো। তাই প্রতি কুটিরের আশপাশে রয়েছে বেশ বড় খোলা জায়গা।
এই রিসোর্টের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এখানকার পুকুর থেকে মাছ ধরা। বার্বিকিউয়ের মজা তো আছেই, সেই সঙ্গে অনেকে সদ্য ধরা মাছ সঙ্গে করে বাড়িতেও নিয়ে যায়।
এখানকার দিনব্যাপী প্যাকেজ ৫,০০০ টাকা। তবে নির্দিষ্ট কিছু কুটিরের জন্য এই প্যাকেজ প্রতি ২ জনের জন্য ৪,০০০ টাকায় নেমে আসে। ২৪ ঘণ্টার জন্য ১০,০০০ টাকা খরচ করতে হয়।
সি শেল এমিউজমেন্ট পার্ক ও রিসোর্ট
কুড়িল ফ্লাই ওভার থেকে মাত্র ১০ মিনিট দূরত্বে ৩০০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন পূর্বাচল রাজউক নতুন শহরের সেক্টর-৩-এ এই রিসোর্টের অবস্থান।
প্রথমত, এটি একটি বিনোদন পার্ক যা পিকনিক স্পটের জন্য সেরা। এতে আছে সি শেল পার্ক, বৃত্তাকার বাগান, সুইমিং পুল, এবং পার্টি সেন্টার। দর্শনার্থীদের ১০০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে সারাদিন এগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। পার্কের বিভিন্ন রাইডগুলোর জন্য আলাদাভাবে খরচ করতে হবে, যা রাইডভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। সুইমিং পুলে সাঁতারের জন্য প্রতি ঘণ্টায় দিতে হবে ২০০ টাকা।
যারা রিসোর্টের সুবিধা পেতে চাইছেন তাদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু এসি ও নন-এসি ডিলাক্স রুম। এগুলোর প্যাকেজ মূল্য প্রতি রাতের জন্য প্রায় ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা।
নিঝুম পল্লী রিসোর্ট
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের পোলখান গ্রামে পড়েছে পূর্বাচলের এই নিঝুম পল্লী রিসোর্ট। কাঞ্চন ব্রিজের আগে বায়ের রোড ধরে যেয়ে জিয়া পার্কের পরেই পোলখান বাজারের কাছে পাওয়া যাবে এই রিসোর্টের প্রবেশপথ।
রূপগঞ্জে গ্রাম্য পরিবেশে প্রায় ১১ বিঘা জায়গার উপর গড়ে উঠেছে এই নান্দনিক স্থাপনাটি। ৪টি কুটির, ৩টি ভিলা রুম এবং একটি রেস্টুরেন্ট, শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাইড; সবমিলিয়ে পরিবার নিয়ে ঘোরার জন্য উপযুক্ত একটি জায়গা।
এতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে নৌকা ভ্রমণ, মাছ ধরা, বারবিকিউ এবং স্কাই ভিউ টেরেস। ১,৫০০ টাকার দিনব্যাপী প্যাকেজে উপভোগ করা যাবে এই সব সুযোগ-সুবিধা। এর মধ্যে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং বিকেলের হাল্কা নাস্তাও অন্তর্ভূক্ত। তবে রুম নেওয়ার ক্ষেত্রে চার্জ আরও বাড়বে।
ফ্যামিলি লাইফ রিসোর্ট
রিসোর্ট হিসেবে বেশ ছোট হলেও এই অল্প জায়গার ভেতরেই আয়োজন করা হয়েছে সকল সুযোগ-সুবিধার। এগুলোর মধ্যে আছে ডাবল ডিলাক্স এসি রুম, একটি নন-এসি কুটির, বার্বিকিউ জোন, সুইমিং পুল, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, জাকুজি, এবং গাড়ি পার্কিং।
যারা রান্না করতে ভালোবাসেন তারা এখানে পাবেন পেশাদার রন্ধনশিল্পীর সঙ্গে রান্না করার সুযোগ। এছাড়া ব্যবস্থা রয়েছে পেশাদার ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তোলার। সার্বক্ষণিক ওয়াইফাই এবং আইপিএস পরিষেবা শহুরে আমেজকে অক্ষুণ্ন রেখেছে।
এখানকার দিনব্যাপী জনপ্রতি ১,৩৫০ টাকার প্যাকেজটি উপভোগ করতে হলে ন্যূনতম ৮ থেকে ১০ জনের গ্রুপ নিয়ে আসতে হবে। তবে নব দম্পতিদের জন্য রয়েছে বিশেষ প্যাকেজ এবং অগ্রিম বুকিং শুধুমাত্র এদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এই রিসোর্টে আসতে হলে কুড়িল থেকে প্রথমে আসতে হবে মাজার রোড বাস স্ট্যান্ডে। তারপর সেখান থেকে বায়ের পথ ধরে জয় বাংলা চত্বর পেরিয়ে পূর্বাচল নিউ টাউনের ১৮ সেক্টর।
পদ্ম শাপলা রিসোর্ট
জিন্দা পার্ক-খ্যাত জিন্দা গ্রামের জিন্দা বা মোদ্দো পাড়ার এই দর্শনীয় স্থানটিকে পুরোপুরি রিসোর্ট বলা চলে না। আদ্যোপান্ত গ্রাম্য পরিবেশকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পুরো জায়গাটি, যেখানে দেখা মিলবে টিনের ঘরের রেস্টুরেন্ট এবং সেখানে মাটির পাত্রে খাবার। বাইরে মোটামুটি মানের পার্কিং-এরও ব্যবস্থা আছে।
তবে জিন্দা পার্ক থেকে মাত্র ৫ মিনিট দূরত্বের এই জায়গাটির বিশেষত্ব হচ্ছে বিস্তৃত পদ্ম বা শাপলার বিল। একসঙ্গে এতগুলো ফুটন্ত শাপলা ফুল ঢাকার আর কোথাও দেখা যায় না। একটু সকাল সকাল এলেই অভিজ্ঞতা নেওয়া যাবে এই অপূর্ব দৃশ্যের। এই পদ্ম বিলের জনপ্রিয়তার কারণেই একে ঘিরে তৈরি হয়েছে রিসোর্টটি।
রিসোর্টে ঢুকতে ৫০ টাকা প্রবেশ মূল্য নেওয়া হয়। রিসোর্টের সর্বত্র ঘোরাঘোরির মাঝে রেস্তোরাঁয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়া যায়।
ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় নৌকা দিয়ে ঘোরা যায় শাপলা বিলে। ৩০ থেকে ৪০ টাকায় কিনে নেওয়া যায় শাপলা ফুল। কাঞ্চন ব্রিজ থেকে টমটম বা সিএনজি করে জিন্দা পার্ক পার হলেই পদ্ম শাপলা রিসোর্ট।
জঙ্গলবাড়ি রিসোর্ট সুইমিং এ্যান্ড রেস্টুরেন্ট
পূর্বাচল ৩০০ ফিট সংলগ্ন বাজেট রিসোর্টগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। মাত্র ২০ টাকা ফি দিয়ে প্রবেশ করে পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখা যায়। সুইমিং পুল ব্যবহার করতে চাইলে ২০০ টাকা খরচ করতে হবে। তবে এদের ৫০০ টাকা প্যাকেজে প্রবেশ, সুইমিং ও লাঞ্চ সহ পুরোটা ঘুরে দেখা যায়।
সুদৃশ্য এই স্থানটির সবচেয়ে দর্শনীয় হচ্ছে ফুলের বাগান ও খেলার মাঠ। এখানে দিনব্যাপী প্যাকেজ ২,০০০ টাকা থেকে শুরু হয়। এতে রাত্রিযাপন যোগ হলে এবং সেই সঙ্গে এসি রুম নিলে খচর আরও বাড়ে। তবে এদের সর্বোচ্চ খরচ ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত। কুড়িল থেকে নীলা মার্কেট এসে সেখান থেকে অটোরিক্সা করে সহজেই আসা যাবে এই রিসোর্টে।
রিসোর্ট বৃষ্টিধারা
পূর্বাচল নিউ টাউনের এই রিসোর্টটি কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে মাত্র ১২ মিনিটের দূরে। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মাজার রোড বাসস্ট্যান্ডে নেমে বাঁয়ে অটোরিক্সা করে পৌঁছানো যায় এই রিসোর্ট। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় এখানে রাত্রিযাপনের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
এখানে আছে ২টি স্যুট, ডাইনিং সহ ফ্যামিলি লিভিং, অত্যাধুনিক ড্রাই কিচেন, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, আউটডোর কিচেন, ফোয়ারা, এবং ইনফিনিটি সুইমিং পুল।
এছাড়া নানা ধরনের জনপ্রিয় ইনডোর ও আউটডোর খেলাধুলার সুযোগ রয়েছে।
বৃষ্টিধারা ঘুরতে হলে ন্যূনতম ৬ জনের গ্রুপ নিয়ে আসতে হবে। গ্রুপে সর্বোচ্চ ২৪ জন সদস্য নেওয়া যাবে। এখানে একবারে শুধু একটি গ্রুপের জন্য রিসোর্ট উপভোগের সুযোগ রাখা হয়েছে। ৬ থেকে ২৪ জনের মধ্যে যেকোনো সংখ্যাক সদস্যের গ্রুপের জন্য দিনব্যাপী প্যাকেজ জনপ্রতি ৩,২৫০ টাকা। প্যাকেজের মধ্যে সকাল ও সন্ধ্যার নাস্তা এবং দুপুরের খাবার অন্তর্ভূক্ত। শীতকালে তথা ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি অব্দি চায়ের সঙ্গে তারা চিতই ও ভাপা পিঠার ব্যবস্থা করে।