গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছেন বিধবা আম্বিয়া খাতুন

গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছেন বিধবা আম্বিয়া খাতুন
ছবি প্রতিনিধি

এলাকাবাসীর অনেকে হাসি-রহস্য, কটুকথা আর ঠাট্টা-মসকরা শুনতে হয়েছে। তবে সেসব কষ্ট দমাতে পারেনি স্বপ্নবাজ অদম্য লাকী কে। নারী উদ্যোক্তা দেশের ডেইরী আইকন নির্বাচিত বিধবা আম্বিয়া খাতুন লাকী সেই সংগ্রামময়, কষ্টের জীবনের গল্পগুলো হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন। শুধু গাভীর খামার নয় তার বাড়ি জুড়ে যেন শুধুই অর্থনীতির গল্প, আছে ছাগল, হাসঁ-মুরগি,কবুতর-পাখি কত কি।

ঝিনাইদহ সদরের প্রত্যন্তপল্লী বাদপুকুরিয়া গ্রামের বিধবা নারী আম্বিয়া খাতুন লাকী। মাত্র ৪টি গাভি নিয়ে শুরু করেন স্বপ্নের খামার। ৪বছরের মাথায় এখন তার খামারে গাভির সংখ্যা ৪০টির বেশী। গেল বছরে ২০ লাখ টাকার গরু বিক্রি করেছেন। এছাড়া প্রতিদিন ২শ৫০ থেকে ৩শ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে তার খামারে। ২০২১ সালে দেশে ৪০জন খামারী ডেইরী আইকন নির্বাচিত হন, আম্বিয়া খাতুন লাকী হন ৫ম আর খুলনা বিভাগের মধ্যে প্রথম। ১লাখ টাকার চেক সহ পুরষ্কার নেন মন্ত্রীর হাত থেকে।
ঝিনাইদহের ডাকবাংলো বাজারে একটি বাড়ি সহ ২’শত দোকানের ২টি মার্কেট গড়েছেন, বছরে তার মোট আয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা।

প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন সহ গ্রামীন অর্থনীতিতে আম্বিয়া খাতুন লাকী একজন আইকন, তার দেখাদেখি গ্রামাঞ্চলের অনেকেই এখন খামারী, গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ করছে। জেলায় ক্ষুদ্র-মাঝারি সহ খামার রয়েছে ৬শতাধিক ।

ঝিনাইদহ জেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের বাদপুকুরিয়া গ্রামের আম্বিয়া খাতুন লাকী এখন খুলনা বিভাগের গৌরব।

জেলার সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের বাদপুকুরিয়া গ্রামের মৃত গোলাম রসুলের কন্যা আম্বিয়া খাতুন লাকী ৫ বোন আর ১ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপাড়ার পর ২০০৫ সালে বিয়ে হয় লাকীর, তবে ২০০৮ সালে তার স্বামী ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেখানেই মারা যান। এরপর আর স্বামীর বাড়িতে জায়গা হয়নি। বাবার বাড়ি চলে আসেন, সেখানেও কয়েক বছর থাকার পর সাংসারিক নানা বিষয়ে বাবার ওপর মান-অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর দালাল ধরে ২০১২ সালে লেবাননে চলে যায়। সেখানেও ভালোই ছিলেন।

নিজ উদ্যোগে গ্রামের বাড়িতে খামার গড়ে তোলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, বিদেশ থাকাকালে একবার রোজার ভেতরে তার মা এক আত্মীয়র বাড়িতে দুধ কিনতে গেলে দুধ না দিয়ে কিছুটা অপমান করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। ঐ দিন থেকেই ইচ্ছা জাগে বাড়ি ফিরে খামার করবেন, একজন নারী উদ্যোক্তা হবেন।

২০১৮ সালে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে সেই প্রতিজ্ঞা আর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে অদম্য লাকী মাত্র চারটি গাভী দিয়ে ‘মা-বাবার দোয়া’ নামে শুরু করেন স্বপ্নের খামার। এখন সেই খামারে ৪০টির বেশী গাভী ও ১৬টি বাছুর । গেল বছরে ২০ লাখ টাকার ষাঁড় গরু বিক্রি করেছেন, এছাড়া প্রতিদিন ২শ৫০ থেকে ৩শ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে । লাকী জানান, এখন তিনি তার খামারের দুধ অভাবী-দারিদ্র মানুষদের অনেক সময় ফ্রী দেন, এতিমখানা সহ শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দেন ।

প্রাণী সম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন( এলডিডিপি) প্রকল্প থেকে দুধ দোহানোর মেশিন ও মাখন সেপারেটের মেশিন দিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১০ কেজি মাখন হয়। সেটা জ্বালিয়ে ৪-৫ কেজি ঘি তৈরি করে প্রায় ১৪০০ টাকা কেজি দরে ঘি বিক্রি করেন। আর মাখন তোলার পর দুধ ৫০ টাকা কেজি দরে মিষ্টির দোকানে দিয়ে দেন। এছাড়া গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানির চাহিদা মেটাচ্ছেন।

উদ্যোক্তা হিসাবে সহজ শর্তে ব্যাংক লোন আর খামারের আয় থেকে করেছেন দুইটি বিশাল মার্কেট ও একটি বাড়ি। খামার আর মার্কেট থেকে এখন বছরে এ নারী উদ্যোক্তার আয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা।

খুলনা বিভাগের গৌরব আম্বিয়া খাতুন লাকী তার আর্থিক সচ্ছলতা প্রসঙ্গে বলেন, ঝিনাইদহের ডাকবাংলো বাজারে বাসস্ট্যান্ডের পাশে দুইটি মার্কেট করেছেন। সাততলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বাড়ি তৈরী করছেন যার দুইতলা কমপ্লিট করেছেন। বাড়ির পাশে টিনশেড দিয়ে একটি মার্কেট সহ দুটি মার্কেটে মোট দোকান আছে ২শ’টি। যার ভাড়া আসে ৮০ হাজার টাকার উপরে।

বাবার সম্পদ-সম্পত্তিসহ পারিবারিক ভাবে লাকী সহ ভাই-বোনেরা মোটামুটি স্বচ্ছল। তবে সেসবের দিকে তাকাতে হয়নি এই নারী উদ্যোক্তার। লাকী জানান, প্রাণী সম্পদ অফিসের এলডিডিপির সহায়তায় তাকে ব্যাংক ঋণ দেয়। বর্তমানে ব্যাংক এশিয়া থেকে এক কোটি টাকার হাউজ লোন নিয়েছেন। এছাড়া ২০১৯ সালে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকার এবং পরে ৩০ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছেন ৪ শতাংশ সুদে। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিতে হয় ব্যাংক কে৷ এসব টাকা খামার ও দোকান ভাড়া থেকে দিয়ে থাকেন।

ঋণের টাকা কিস্তিতে দেওয়ার পর সব মিলিয়ে আয় হয় বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। নারী উদ্যোক্তা হিসাবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্বরুপ জাতীয় ও স্থানীয় অনেকগুলি পুরষ্কারও পেয়েছেন আম্বিয়া খাতুন লাকী। ২০২১ সালে দেশের ৪০জন ডেইরী আইকনের মধ্যে ৫ম স্থান অধিকার আর খুলনা বিভাগের মধ্যে প্রথম হওয়া সহ পশুমেলা পুরস্কার, ঝিনাইদহ নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার এবং নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জয়িতার প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খামারের সমস্ত কাজের তদারকি আম্বিয়া খাতুন লাকী নিজেই করে থাকেন। বুঝিয়ে দেন খামারের ৪ জন কর্মচারীর সকল কাজ । খামারে লাকীর ভাইয়েরাও সাহায্য করে থাকেন। নারী উদ্যোক্তা লাকী তার দুই ভাইয়ের সংসার ও মাকে দেখা শোনা করছেন। এখন লাকীর একটাই স্বপ্ন তার খামারে গাভীর সংখ্যা ১’শতে উন্নিত করা এবং দেশের সফল নারী উদ্যোক্তা হওয়া।

অদম্য লাকী তার খামারের শুরুর গল্প বলতে গিয়ে জানান, এলাকাবাসীর অনেকে হাসি-রহস্য, কটুকথা আর ঠাট্টা-মসকরা শুনতে হয়েছে। তবে সেসব কষ্ট দমাতে পারেনি স্বপ্নবাজ অদম্য লাকী কে। দেশের ডেইরী আইকন নির্বাচিত বিধবা আম্বিয়া খাতুন লাকী সেই সংগ্রামময়, কষ্টের জীবনের গল্পগুলো হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন। শুধু গাভীর খামার নয় তার বাড়ি যেন শুধুই অর্থনীতির গল্প, আছে ছাগল, হাসঁ-মুরগি,কবুতর-পাখি, সবই বনিজ্যিক ভিত্তিতে চলে বেঁচা-কেনা।

আম্বিয়া খাতুন লাকী এখন যেন সবার নয়নের মণি। সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের ২নং বাদপুকুরিয়া ওয়ার্ডে ১বছর আগে বিপুল ভোটে সংরক্ষিত ইউপি সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। এই নারী উদ্যোক্তা জানান,গরু পালন আর খামারের জন্য উন্নত ঘাসের কোন বিকল্প নেই। তিনি ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে নেপিয়ার, পাকচং সহ ৩জাতের ঘাষ চাষ করছেন গরুর খাবারের জন্য।

গ্রামের মানুষ, এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি সহ সবার কাছেই লাকী এখন প্রশংসার পাত্র। দেশের ডেইরী আইকন নির্বাচিত আম্বিয়া খাতুন লাকীর গাভির খামার দেখতে প্রতিদিন আসে অনেক মানুষ, অনেকে দেখাদেখি গড়ে তুলছেন খামারও । গ্রামের ইউপি সদস্য আলী আকবর জানান, একজন নারী হয়ে লাকী যা করছেন তাতে এলাকাবাসী গর্বিত। বাদপুকুরিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, একজন নারী যা করছে পুরুষ হয়েও আমরা তা পারেনি। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাশ্ববর্তী হরিণাকুন্ডু উপজেলার ভাতুরিয়া গ্রামের ওহিদুল ইসলাম তার বন্ধুর সাথে দেখতে এসেছেন লাকীর গরুর ফার্ম, তিনি বলছিলেন আগে থেকেই শুনেছেন এই বিধাব নারীর গাভীর খামারের কথা, আজ দেখতে এসেছেন এবং তিনি ফার্ম গড়ে তুলবেন।

আম্বিয়া খাতুন লাকির জন্য গর্বিত তার মা আয়েশা খাতুন, বলছিলেন তার জন্যেই মেয়ের যত পরিশ্রম আর সে পথ ধরেই এসেছে সাফল্য।
ঝিনাইদহ জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা( ভারপ্রাপ্ত) মনোজিৎ কুমার সরকার বলেন,নারীর ক্ষমতায়ন সহ গ্রামীন অর্থনীতিতে আম্বিয়া খাতুন লাকী একজন আইকন, তার দেখাদেখি গ্রামাঞ্চলের অনেকেই এখন খামারী, গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ করছে। প্রাণী সম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন প্রকল্প সহ বিভিন্ন প্রকল্পে নারীদের অগ্রাধিকার সহ সহায়তা করা হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছেন বিধবা আম্বিয়া খাতুন

গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছেন বিধবা আম্বিয়া খাতুন
ছবি প্রতিনিধি

এলাকাবাসীর অনেকে হাসি-রহস্য, কটুকথা আর ঠাট্টা-মসকরা শুনতে হয়েছে। তবে সেসব কষ্ট দমাতে পারেনি স্বপ্নবাজ অদম্য লাকী কে। নারী উদ্যোক্তা দেশের ডেইরী আইকন নির্বাচিত বিধবা আম্বিয়া খাতুন লাকী সেই সংগ্রামময়, কষ্টের জীবনের গল্পগুলো হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন। শুধু গাভীর খামার নয় তার বাড়ি জুড়ে যেন শুধুই অর্থনীতির গল্প, আছে ছাগল, হাসঁ-মুরগি,কবুতর-পাখি কত কি।

ঝিনাইদহ সদরের প্রত্যন্তপল্লী বাদপুকুরিয়া গ্রামের বিধবা নারী আম্বিয়া খাতুন লাকী। মাত্র ৪টি গাভি নিয়ে শুরু করেন স্বপ্নের খামার। ৪বছরের মাথায় এখন তার খামারে গাভির সংখ্যা ৪০টির বেশী। গেল বছরে ২০ লাখ টাকার গরু বিক্রি করেছেন। এছাড়া প্রতিদিন ২শ৫০ থেকে ৩শ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে তার খামারে। ২০২১ সালে দেশে ৪০জন খামারী ডেইরী আইকন নির্বাচিত হন, আম্বিয়া খাতুন লাকী হন ৫ম আর খুলনা বিভাগের মধ্যে প্রথম। ১লাখ টাকার চেক সহ পুরষ্কার নেন মন্ত্রীর হাত থেকে।
ঝিনাইদহের ডাকবাংলো বাজারে একটি বাড়ি সহ ২’শত দোকানের ২টি মার্কেট গড়েছেন, বছরে তার মোট আয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা।

প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন সহ গ্রামীন অর্থনীতিতে আম্বিয়া খাতুন লাকী একজন আইকন, তার দেখাদেখি গ্রামাঞ্চলের অনেকেই এখন খামারী, গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ করছে। জেলায় ক্ষুদ্র-মাঝারি সহ খামার রয়েছে ৬শতাধিক ।

ঝিনাইদহ জেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের বাদপুকুরিয়া গ্রামের আম্বিয়া খাতুন লাকী এখন খুলনা বিভাগের গৌরব।

জেলার সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের বাদপুকুরিয়া গ্রামের মৃত গোলাম রসুলের কন্যা আম্বিয়া খাতুন লাকী ৫ বোন আর ১ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপাড়ার পর ২০০৫ সালে বিয়ে হয় লাকীর, তবে ২০০৮ সালে তার স্বামী ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেখানেই মারা যান। এরপর আর স্বামীর বাড়িতে জায়গা হয়নি। বাবার বাড়ি চলে আসেন, সেখানেও কয়েক বছর থাকার পর সাংসারিক নানা বিষয়ে বাবার ওপর মান-অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর দালাল ধরে ২০১২ সালে লেবাননে চলে যায়। সেখানেও ভালোই ছিলেন।

নিজ উদ্যোগে গ্রামের বাড়িতে খামার গড়ে তোলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, বিদেশ থাকাকালে একবার রোজার ভেতরে তার মা এক আত্মীয়র বাড়িতে দুধ কিনতে গেলে দুধ না দিয়ে কিছুটা অপমান করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। ঐ দিন থেকেই ইচ্ছা জাগে বাড়ি ফিরে খামার করবেন, একজন নারী উদ্যোক্তা হবেন।

২০১৮ সালে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে সেই প্রতিজ্ঞা আর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে অদম্য লাকী মাত্র চারটি গাভী দিয়ে ‘মা-বাবার দোয়া’ নামে শুরু করেন স্বপ্নের খামার। এখন সেই খামারে ৪০টির বেশী গাভী ও ১৬টি বাছুর । গেল বছরে ২০ লাখ টাকার ষাঁড় গরু বিক্রি করেছেন, এছাড়া প্রতিদিন ২শ৫০ থেকে ৩শ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে । লাকী জানান, এখন তিনি তার খামারের দুধ অভাবী-দারিদ্র মানুষদের অনেক সময় ফ্রী দেন, এতিমখানা সহ শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দেন ।

প্রাণী সম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন( এলডিডিপি) প্রকল্প থেকে দুধ দোহানোর মেশিন ও মাখন সেপারেটের মেশিন দিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১০ কেজি মাখন হয়। সেটা জ্বালিয়ে ৪-৫ কেজি ঘি তৈরি করে প্রায় ১৪০০ টাকা কেজি দরে ঘি বিক্রি করেন। আর মাখন তোলার পর দুধ ৫০ টাকা কেজি দরে মিষ্টির দোকানে দিয়ে দেন। এছাড়া গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানির চাহিদা মেটাচ্ছেন।

উদ্যোক্তা হিসাবে সহজ শর্তে ব্যাংক লোন আর খামারের আয় থেকে করেছেন দুইটি বিশাল মার্কেট ও একটি বাড়ি। খামার আর মার্কেট থেকে এখন বছরে এ নারী উদ্যোক্তার আয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা।

খুলনা বিভাগের গৌরব আম্বিয়া খাতুন লাকী তার আর্থিক সচ্ছলতা প্রসঙ্গে বলেন, ঝিনাইদহের ডাকবাংলো বাজারে বাসস্ট্যান্ডের পাশে দুইটি মার্কেট করেছেন। সাততলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বাড়ি তৈরী করছেন যার দুইতলা কমপ্লিট করেছেন। বাড়ির পাশে টিনশেড দিয়ে একটি মার্কেট সহ দুটি মার্কেটে মোট দোকান আছে ২শ’টি। যার ভাড়া আসে ৮০ হাজার টাকার উপরে।

বাবার সম্পদ-সম্পত্তিসহ পারিবারিক ভাবে লাকী সহ ভাই-বোনেরা মোটামুটি স্বচ্ছল। তবে সেসবের দিকে তাকাতে হয়নি এই নারী উদ্যোক্তার। লাকী জানান, প্রাণী সম্পদ অফিসের এলডিডিপির সহায়তায় তাকে ব্যাংক ঋণ দেয়। বর্তমানে ব্যাংক এশিয়া থেকে এক কোটি টাকার হাউজ লোন নিয়েছেন। এছাড়া ২০১৯ সালে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকার এবং পরে ৩০ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছেন ৪ শতাংশ সুদে। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিতে হয় ব্যাংক কে৷ এসব টাকা খামার ও দোকান ভাড়া থেকে দিয়ে থাকেন।

ঋণের টাকা কিস্তিতে দেওয়ার পর সব মিলিয়ে আয় হয় বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। নারী উদ্যোক্তা হিসাবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্বরুপ জাতীয় ও স্থানীয় অনেকগুলি পুরষ্কারও পেয়েছেন আম্বিয়া খাতুন লাকী। ২০২১ সালে দেশের ৪০জন ডেইরী আইকনের মধ্যে ৫ম স্থান অধিকার আর খুলনা বিভাগের মধ্যে প্রথম হওয়া সহ পশুমেলা পুরস্কার, ঝিনাইদহ নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার এবং নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জয়িতার প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খামারের সমস্ত কাজের তদারকি আম্বিয়া খাতুন লাকী নিজেই করে থাকেন। বুঝিয়ে দেন খামারের ৪ জন কর্মচারীর সকল কাজ । খামারে লাকীর ভাইয়েরাও সাহায্য করে থাকেন। নারী উদ্যোক্তা লাকী তার দুই ভাইয়ের সংসার ও মাকে দেখা শোনা করছেন। এখন লাকীর একটাই স্বপ্ন তার খামারে গাভীর সংখ্যা ১’শতে উন্নিত করা এবং দেশের সফল নারী উদ্যোক্তা হওয়া।

অদম্য লাকী তার খামারের শুরুর গল্প বলতে গিয়ে জানান, এলাকাবাসীর অনেকে হাসি-রহস্য, কটুকথা আর ঠাট্টা-মসকরা শুনতে হয়েছে। তবে সেসব কষ্ট দমাতে পারেনি স্বপ্নবাজ অদম্য লাকী কে। দেশের ডেইরী আইকন নির্বাচিত বিধবা আম্বিয়া খাতুন লাকী সেই সংগ্রামময়, কষ্টের জীবনের গল্পগুলো হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন। শুধু গাভীর খামার নয় তার বাড়ি যেন শুধুই অর্থনীতির গল্প, আছে ছাগল, হাসঁ-মুরগি,কবুতর-পাখি, সবই বনিজ্যিক ভিত্তিতে চলে বেঁচা-কেনা।

আম্বিয়া খাতুন লাকী এখন যেন সবার নয়নের মণি। সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের ২নং বাদপুকুরিয়া ওয়ার্ডে ১বছর আগে বিপুল ভোটে সংরক্ষিত ইউপি সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। এই নারী উদ্যোক্তা জানান,গরু পালন আর খামারের জন্য উন্নত ঘাসের কোন বিকল্প নেই। তিনি ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে নেপিয়ার, পাকচং সহ ৩জাতের ঘাষ চাষ করছেন গরুর খাবারের জন্য।

গ্রামের মানুষ, এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি সহ সবার কাছেই লাকী এখন প্রশংসার পাত্র। দেশের ডেইরী আইকন নির্বাচিত আম্বিয়া খাতুন লাকীর গাভির খামার দেখতে প্রতিদিন আসে অনেক মানুষ, অনেকে দেখাদেখি গড়ে তুলছেন খামারও । গ্রামের ইউপি সদস্য আলী আকবর জানান, একজন নারী হয়ে লাকী যা করছেন তাতে এলাকাবাসী গর্বিত। বাদপুকুরিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, একজন নারী যা করছে পুরুষ হয়েও আমরা তা পারেনি। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাশ্ববর্তী হরিণাকুন্ডু উপজেলার ভাতুরিয়া গ্রামের ওহিদুল ইসলাম তার বন্ধুর সাথে দেখতে এসেছেন লাকীর গরুর ফার্ম, তিনি বলছিলেন আগে থেকেই শুনেছেন এই বিধাব নারীর গাভীর খামারের কথা, আজ দেখতে এসেছেন এবং তিনি ফার্ম গড়ে তুলবেন।

আম্বিয়া খাতুন লাকির জন্য গর্বিত তার মা আয়েশা খাতুন, বলছিলেন তার জন্যেই মেয়ের যত পরিশ্রম আর সে পথ ধরেই এসেছে সাফল্য।
ঝিনাইদহ জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা( ভারপ্রাপ্ত) মনোজিৎ কুমার সরকার বলেন,নারীর ক্ষমতায়ন সহ গ্রামীন অর্থনীতিতে আম্বিয়া খাতুন লাকী একজন আইকন, তার দেখাদেখি গ্রামাঞ্চলের অনেকেই এখন খামারী, গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ করছে। প্রাণী সম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন প্রকল্প সহ বিভিন্ন প্রকল্পে নারীদের অগ্রাধিকার সহ সহায়তা করা হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

এজেড নিউজ বিডি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Download
ঠিকানা: পূর্ব কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ নিবন্ধনের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত