আসন্ন ঈদ-উল-ফিতর ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন টাঙ্গাইলের তাঁতিরা। নজরকাড়া আর বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লিগুলোতে। ব্যস্ততা সামাল দিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও শাড়ি তৈরিতে নেমেছেন সমানতালে। এখন প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শাড়ি তৈরির কাজ করছেন তারা। যদিও মজুরি নিয়ে নাখোশ কারিগররা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তাঁতের রাজধানী খ্যাত টাঙ্গাইলের পাথরাইল ছাড়াও বাজিতপুর, এলাসিন, করটিয়া, বল্লা, এনায়েতপুর, পোড়াবাড়ি, চারাবাড়ি, বাঘিলসহ প্রায় সবকটি তাঁত পল্লি খটখট শব্দে মুখর। জেলার তাঁত পল্লির পাশাপাশি ব্যস্ততা বেড়েছে বিপণি-বিতানেও। দেশি-বিদেশি ক্রেতারা ভিড় করছেন সেখানে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুতি কাপড়ের শাড়ি ৬০০ টাকা থেকে ২৫,০০০, মার্সরাইজড কটন ১,২৫০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিল্ক, সফট সিল্ক, হাফ সিল্ক, মসলিন, অ্যান্ডি সিল্ক ও জামদানি শাড়ি ২,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
কারিগররা বলছেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ব্যস্ততা বেড়েছে ঠিকই, তবে মজুরি কম। কম মজুরি দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
প্রায় ৩৫ বছর ধরে তাঁতে শাড়ি তৈরির কাজ করেন মো. রশিদ। তিনি বলেন, “বর্তমানে সুতার দাম বেশি। কিন্তু কাপড়ের দাম কম। এতে করে মালিকেরও কিছু থাকে না, আমাদেরও কিছু থাকে না। এই মজুরি দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। তবুও ঈদ এবং বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা শাড়ি বুননের কাজ করছি।”
তাঁত শ্রমিক মুসলিম মিয়া বলেন, “একটা শাড়ি তৈরিতে প্রায় দুই দিন সময় লাগে। পেটের তাগিদে এ পেশা ধরে রেখেছি। মহাজনে ঠিকমতো কাপড় বিক্রি করতে পারলে আমাদের কাজ দেয়। আর বিক্রি করতে না পারলে আমাদের কাজ দেয় না। এভাবেই চলছে।”
আরফান আলী নামে এক কারিগর বলেন, “টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি হয়। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে তিন-চার দিন। বিক্রি হয় ৩,০০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। মজুরি দেয় মাত্র ১০০০ টাকা। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করে চলতে হয়। বেশিরভাগই এ পেশা থেকে চলে গেছেন। আমি অন্য কোনো কাজ আর শিখি নাই। এজন্য আমি যেতে পারিনি। আমাদের মজুরি বাড়ানো হলে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারব।”
পাথরাইল এলাকার তাঁত মালিক গোবিন্দ সূত্রধর বলেন, “বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ডলুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। খরচ বেশি হওয়ায় হ্যান্ডলুমের শাড়ির দামও বেশি। আর পাওয়ার লুমের শাড়ি পাওয়া যায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। হ্যান্ডলুমের শাড়ি তৈরি করতে মজুরিই দিতে হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। এজন্য আমাদের শাড়ি কম চলে। তারপরও আশা করছি, এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ প্রায় একই সময়ে হওয়ায় বিক্রি ভালো হবে।”
এদিকে, টাঙ্গাইলের শাড়ি কিনতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে জেলার তাঁত পল্লি ও বিপণি-বিতানগুলোতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। ভারত থেকেও শাড়ি কিনতে আসছেন অনেকে।
ভারত থেকে আসা স্বপ্না বসাক নামে এক ক্রেতা গণমাধ্যমকে বলেন, “নর্ববষ উপলক্ষে আমি স্বামীকে নিয়ে টাঙ্গাইলের শাড়ি কিনতে এসেছি। টাঙ্গাইল শাড়ির মান ও দাম অনেক ভালো।”
কিশরী মন বসাক নামে আরেক ভারতীয় ক্রেতা বলেন, “আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে শাড়ি কেনার জন্য এসেছি। শাড়ি দেখে আমাদের পছন্দ হয়েছে। সঙ্গে পাঞ্জাবিও কিনব।”
প্রতিবছর ঈদ ও নববর্ষের মতো উৎসবের জন্য টাঙ্গাইলের শাড়ি কেনেন সুমাইয়া শিমু। এই ক্রেতা বললেন, “ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দুটি তাঁতের শাড়ি নিয়ে গেলাম। পরিবারের জন্যও তিনটি নিয়েছি। শাড়ির মান ও ডিজাইন অনেক ভালো। আগের থেকে এবার দাম বেশি রাখছে। দাম একটু কম হলে ভালো হতো।”
টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক বলেন, “টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে এবার নতুনত্ব এসছে। টাঙ্গাইল শাড়িতে যে কোনো সময়ে নতুনত্ব আনা সম্ভব। এরই মধ্যে অনেক শাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। গরমকে বিবেচনা করে সুতির শাড়ি, মার্সরাইজড কটন এবং সফট সিল্ক শাড়িগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে।”
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকার কারণে ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫% বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হবে। অনেক শাড়িই বিক্রি হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “তাঁত ও তাঁতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। জেলায় বর্তমানে ৭২ থেকে ৭৫% তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “এবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৭৫ লাখ পিস শাড়ি রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি আমাদের ধরে রাখতে হবে। কারণ শুধু আমাদের দেশের বাজার দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বিভিন্ন হাটের কারণে টাঙ্গাইল শাড়ির মান কিছুটা কমেছে।”
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের লিয়াজো অফিসার রবিউল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, “তাঁতিদের আমরা চলমান প্রক্রিয়ায় ঋণ দিয়ে থাকি। প্রণোদনামূলক ঋণ হিসেবে ৫% সার্ভিস চার্জে তাঁতিদের সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ঋণ দিতে পারি।”