ঈদের আনন্দ উদযাপনে সবাই চায় এ দিনটিতে পছন্দের খাবার আয়োজন করতে। আর পছন্দের খাবার তালিকায় গরুর মাংস যেন সবার শীর্ষে। কিন্তু দামের কারণে ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্যে সবার তা জোটে না!
গরুর মাংসের ক্রমবর্ধমান বাজার মূল্যে অনেক পরিবারের ঈদ আনন্দে যখন ভাটা পড়তে শুরু করেছে, তখনই বিকল্প হিসেবে রাজশাহীতে জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে “মাংস সমিতি”। ঈদে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মাংস খেতে বছর ধরে এ মাংস সমিতিতে সঞ্চয় করছেন মানুষ।
জানা গেছে, রাজশাহীর পবা উপজেলার দামকুড়া থানার মুরারীপুর নিচপাড়া এলাকা। এ এলাকায় অন্তত দুইশো পরিবারের বসবাস। এখানকার হাতে গোনা দুই-একটি পরিবার ছাড়া সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত। যাদের সিংহভাগের পেশা কৃষি। পরিবারের নানা অভাব-অনটনের মধ্যে ঈদের দিনটিকে সুন্দর খাবার আয়োজনে এ বছর অধিকাংশ পরিবারই মাংস সমিতিতে সঞ্চয় করেছেন।
এলকায় এ বছর মোট চারটি “মাংস সমিতি” এবার সক্রিয় ছিল। গত ২৬ ও ২৭ রজমানে এই চার সমিতির চারটি গরু জবাই করে মাংস ভাগ করে নিয়েছেন সদস্যরা। একেকটি গরুর ওজন ছিল ৬ থেকে ৮ মণ।
একটি সমিতির সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছেন পবা উপজেলার দামকুড়া থানার মুরারীপুর নিচপাড়া এলাকা সজিব হোসেন। তিনি বলেন, “আমাদের এলাকায় অধিকাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। যারা ঈদের সময় সন্তান, পরিবার-পরিজনের জন্য পোশাকসহ অন্যান্য বাজার করার পর এতো দামের মাংস পাতে জুটাতে পারেন না। অনেক পরিবার ব্রয়লার মাংস দিয়েই সাধ মেটানোর চেষ্টা করেন। আবার কেউ কেউ মাছ দিয়েও ঈদের খাবার আয়োজন শেষ করেন। এ কারণেই মাংস সমিতি গল্পের ছলেই গত বছর তৈরি হয়। এখন তা খুব জনপ্রিয় “
সমিতির সদস্য মো. ইয়াসিন আলী বলেন, “প্রতি সপ্তাহে ১০০ টাকা করে মাংস সমিতিতে জমা করতাম। আসলে সমিতি না করলে গরু মাংসের যে দাম, তাতে মাংস খাওয়া আর হবে না। এবার প্রায় ৭ কেজি মাংস পেয়েছি। পরিবারের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের আতিথেয়তায় মাংস নিয়ে তেমন ভাবতে হয়নি। বিগত বছরগুলোতে এ সময় ধার করতে হয়েছে।”
আরেক সদস্য মিনারুল ইসলাম বলেন, “একজনের আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হয়। ঈদের সময় পরিবারের জন্য পোশাক কিনতে গিয়েই হাত ফাঁকা হয়ে যায়। এরমধ্যে ঈদের সময় আত্মীয় স্বজনরা আসে। সবমিলিয়ে ঈদ উৎসবকালীন অনেক ধার হয়ে যায়। অনেক সময় ঋণ পর্যন্ত করতে হয়েছে। তবে এবার আর মাংস নিয়ে বাড়তি তেমন কোনো চিন্তা নাই। কষ্ট করে প্রতি সপ্তাহে যা জমিয়েছি, তা দিয়েই এবারের ঈদে তৃপ্তি সহকারে মাংস খেতে পারব।”
তবে এ সমিতি শুধু রাজশাহীর একটি গ্রাম নয়, গত বছর থেকে মহানগরসহ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে গত বছর থেকে এ ধরনের মাংস সমিতি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেটিতে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গোচর, কুশাবাড়িয়া, পিয়াদাপাড়া, বাউসা, তেঁতুলিয়া, দীঘা, সরেরহাট, মনিগ্রাম, বলিহার, হরিরামপুর, মীরগঞ্জ, চণ্ডীপুর, ছয়ঘটি, খায়েরহাট, জোতরাঘোব, পীরগাছা, নূরনগর, আড়পাড়া, কিশোরপুর, চকরাজাপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে পাঁচ শতাধিক সমিতি গড়ে উঠেছে। সমিতির সদস্যরা সপ্তাহে ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে জমা দেন। কেউ দেন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। অনেকে আবার বছরের পুরো টাকা একত্রে দেন। এভাবে টাকা জমিয়ে ঈদ-উল-ফিতরের আগে গরু কেনা হয়। সেই গরু জবাই করে মাংস ভাগ করে নেন সমিতির সদস্যরা। এতে দরিদ্র পরিবারগুলো বাড়তি আনন্দ পায় এবং তাদের আর্থিক চাপও কমে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাংসের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় দিনে দিনে সমিতির সংখ্যা বাড়ছে। এখন শুধু নিম্ন ও মধ্যবিত্তই নয়, এই সমিতিতে যোগ দিয়েছেন ধনীরাও। এতে এখন যোগ হয়েছেন শিক্ষক, সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিজীবীরা।
এ ব্যাপারে বাঘা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, “উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভালো। তারা নিজেরা সঞ্চয়ী হচ্ছে। বছরব্যাপী সঞ্চয় করা টাকা দিয়ে ঈদের আগে গরু কিনলে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে না। উপরন্তু ঈদে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সবাই ভালো খাবারও খেতে পারল। মাংস সমিতি এলাকার মানুষের মাঝে মেলবন্ধন তৈরিতে অনেকটা সহায়ক হয়েছে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, “কোনো একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, দেশের বিশেষায়িত একটি উৎসব উদযাপনকেন্দ্রীক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গ্রামে গ্রামে এমন সমিতি প্রশংসনীয়। নিজেদের চাহিদা পূরণে কারও কাছে হাত না পেতে এক মুঠো এক মুঠো করে সবাই মিলে চাল জমিয়ে একটি উৎসব আয়োজনের এ সামাজিকতা বহু আগের। তেমনি গ্রামে গ্রামে এমন সমিতি প্রশংসার। তবে শুধু একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। কারণ আমাদের সমস্যা শুধু একটি পণ্যে নয়। সামাজের আরও যত সমস্যা আছে তা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাধানে অগ্রসর হতে হবে। তবে একটি সুন্দর সমাজ বির্নিমান হবে। আর এক্ষেত্রে সুশিক্ষিত মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।”
এ বিষয়ে ক্যাবের রাজশাহী শাখা সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, “সামাজিক এ প্রথা অনেক আগের। তবে সাম্প্রতিকালে এটির প্রচলন তেমন ছিল না। কিন্তু এখন বাজারে মাংস ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই এ সমিতি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে এটা কোনোপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান না।”